জাফর ইকবাল
১৪ অক্টোবর ২০২৪
যমুনা অয়েল কোম্পানীর শীর্ষ কর্মকর্তা এ কে এম জাহিদ সরওয়ারের বিরুদ্ধে কালোবাজারে তেল বিক্রিসহ নানা অভিযোগ উঠেছে। ‘তেলখেকো’ নামে পরিচিত এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে একাধিকবার কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নেয়ায় যমুনায় ক্ষোভ বাড়ছে। তারা বলছেন, অনিয়ম দুর্নীতি করে এই অসাধু কর্তা অবৈধভাবে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। ঢাকার সাভার, গ্রামের বাড়ি মুন্সিগঞ্জসহ একাধিকস্থানে রয়েছে বহুতল বাড়ি। তারা বলছেন, বারবার তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আসলেও মোটা অংকের ঘুষ দিয়ে পার পেয়ে যান তিনি। এবার তারা আন্দোলনে যাবেন বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।
অভিযোগে প্রকাশ, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) বিপণন প্রতিষ্ঠান যমুনা অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের ডিপো সুপারিনটেনডেন্ট এ কে এম জাহিদ সরওয়ার যেখানে দায়িত্ব পেয়েছেন, সেখানেই জ্বলেছে লাল বাতি! প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ গোল্লায় গেলেও নিজে উঠেছেন ফুলেফেঁপে। খুলনার মোংলা ডিপো দেখেছে তার সর্বশেষ তেলেসমাতি! তাপমাত্রাজনিত অপারেশনাল ক্ষতি দেখিয়ে জাহিদের বিরুদ্ধে প্রায় ২৭ হাজার লিটার ডিজেল কালোবাজারে বিক্রির অভিযোগ উঠেছে।
জানা গেছে, মোংলা ডিপোয় থাকাকালে নানা অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন জাহিদ। চলতি বছরের ২৬ মে উপকূলে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় রিমাল। কিন্তু তিনি রিমালের কারণে ক্ষতি দেখিয়েছেন জুন মাসে। মোংলা অয়েল ইনস্টলেশন ডিপোতে মাসিক লাভ-ক্ষতির হিসাবে তেল বিক্রির পরিমাণ পরিবর্তন করে জাহিদের বিরুদ্ধে প্রায় ৩০ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। লাভ-ক্ষতির বিবরণে দেখা যায়, জুনে প্রথমে বিক্রি দেখানো হয় ১ লাখ ২৬ হাজার ৪০০ লিটার। এর মধ্যে অপারেশনাল ক্ষতি ১ হাজার ৫৯০ ও তাপমাত্রাজনিত (৩০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড) ক্ষতি হয় ৭১৮ লিটার।
সূত্র মতে, তাপমাত্রার হেরফেরে জ্বালানি তেলের ঘনত্ব বাড়ে-কমে। অভিযোগ উঠেছে, এটিকেই সুযোগ হিসেবে কাজে লাগান জাহিদ সরওয়ার। মোংলা ডিপোতে চুরি ধরা পড়ার পর তিনি জুনের বিক্রির সঙ্গে ক্ষতি সমন্বয় করেন। একটি সংশোধনীতে দেখানো হয়, জুনে জ্বালানি তেল বিক্রি হয় ৯৯ হাজার লিটার। এর মধ্যে তাপমাত্রাজনিত ক্ষতি ২৭ হাজার ৯৪১ লিটার। মূলত এভাবে পুরো তেল ‘হাওয়া’ দেখিয়ে কালোবাজারে বিক্রি করেন জাহিদ। পরে আত্মসাৎ করা তেলের পরিমাণে সামঞ্জস্য রাখতেই জুনে প্রতিদিন বিক্রিতে ক্ষতি দেখানো হয়।
সংশ্লিষ্টরা জানান, জাহিদের হিসাব নিয়ে খটকা থাকায় কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করেনি। এর পর প্রভাব খাটিয়ে বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেন তিনি। সমালোচনার এক পর্যায়ে ডিপো থেকে প্রত্যাহার করে গত সেপ্টেম্বরে জাহিদকে কোম্পানির চট্টগ্রামের প্রধান কার্যালয়ে সংযুক্ত করা হয়। অভিযোগ মাথায় নিয়ে সহকারী মহাব্যবস্থাপক (বিক্রয় ও বিতরণ) পদে পদোন্নতি পান। তেলে ভেজাল করাসহ বিভিন্ন অভিযোগ থাকলেও তিনি ভালো জায়গায় পদায়নের জন্য মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে তদবির করছেন বলে জানা গেছে।
জানা যায়, জাহিদ সরওয়ারের বিরুদ্ধে অভিযোগ এবারই শেষ নয়। ২০০৬ সালে যমুনার ফতুল্লা ডিপোতে সিনিয়র অপারেশনাল অফিসার থাকাকালে জাহিদ সাময়িক বরখাস্ত হন। ডিপোতে বিভিন্ন অনিয়ম, বিশৃঙ্খলা ও কোম্পানির স্বার্থ পরিপন্থি কাজের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে তাকে এ শাস্তি দেওয়া হয়। কর্মকর্তা-কর্মচারী ও তাদের পরিবারের সদস্যদের চিকিৎসা ব্যয় বহন করে যমুনা অয়েল। এখানেও জালিয়াতি করে জাহিদ একই পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিল একাধিকবার নিয়েছেন বলে অভিযোগ ছিল। নিয়মবহির্ভূতভাবে মায়ের চিকিৎসা বিল তুলে শাস্তির মুখোমুখি হয়েছেন বলে জানা গেছে।
যমুনার তথ্যমতে, প্রতিষ্ঠানের বাঘাবাড়ী ডিপোতে ২০১৭ সালের ১৭ অক্টোবর থেকে ২০২১ সালের ২৩ মার্চ পর্যন্ত দায়িত্বে ছিলেন জাহিদ সরওয়ার। এ সময়ে কোম্পানির সবচেয়ে বেশি অপারেশনাল লোকসান হয়, যা শূন্য দশমিক ২৮ শতাংশে দাঁড়ায়। এক পর্যায়ে তাকে বদলি করে এবং পরবর্তী তিন অর্থবছরে লোকসানের পরিমাণ কমে শূন্য দশমিক ১৮ শতাংশে আসে। এ ছাড়া ২০২১ সালের শুরুতে যমুনা অয়েলের বাঘাবাড়ী ডিপোর কর্মকর্তা হিসেবে জাহিদের অনিয়ম-দুর্নীতি ও বাজে আচরণের প্রতিবাদে ট্যাঙ্কলরি চালকরা তেল পরিবহন বন্ধ করে দেন। এতে উত্তরবঙ্গে জ্বালানি সংকট দেখা দেয়। কিন্তু এ তথ্য কোম্পানিকে জানাননি জাহিদ। পরে জানাজানি হলে তাকে প্রত্যাহার করে নেয়। কিন্তু দেড় মাস না যেতেই তিনি বাঘাবাড়ীর মতো আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ খুলনার মোংলা ডিপোতে পোস্টিং নেন ১৮ মে।
অভিযোগ রয়েছে, এ পোস্টিংয়ের জন্য জাহিদ কোম্পানির তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালককে মোটা অঙ্কের টাকা ঘুষ দেন। এ নিয়ে যমুনায় ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার জন্ম হয়। আগে মোংলা ডিপো লাভে থাকলেও জাহিদ সরওয়ার যাওয়ার পর থেকে প্রতিবছর লোকসান দিয়েছে বলে তথ্যে জানা গেছে।
মংলা ডিপোতে ২০২ সালের জুলাই থেকে চলতি বছরের জনু পর্যন্ত ডিজেল বিক্রিতে অপারেশনাল ও কার্যকালীন ক্ষতি দেখানো হয় শূন্য দশমিক ৫১ শতাংশ। যমুনা অয়েলের ইতিহাসে এভাবে ক্ষতি আর কখনো ঘটেনি বলে জানা গেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিভিন্নখাতে ক্ষতির নামে তেল নয়ছয় করেছেন জাহিদ সরওযার।
এদিকে গত ১৪ অক্টোবর দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান বরাবর তার দুর্নীতি ও অনিয়মের তদন্ত ও বিচার দাবি করে দরখাস্ত দেয়া হয়েছে। এতে জাহিদ সরওয়ারের বিভিন্ন অনিয়মের চিত্র তুলে ধরার পাশাপাশি তার অঢেল সম্পদেরও বিবরণ দেয়া হয়। এতে বলা হয়, তার বেপরোয়া দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে যমুনা সুনাম ক্ষুন্ন হচ্ছে। তার এ অন্যায়ের যারাই প্রতিবাদ করেছে তাদের উপর নানাভাবে হয়রানি করা হতো। যমুনার তার অনিয়ম দুর্নীতি ওপেন সিক্রেট হলেও তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছ্ েনা।
অভিযোগে প্রকাশ, কালোবাজারে তেল বিক্রিসহ নানা অনিয়ম দুর্নীতির মাধ্যমেজাহিদ সরওয়ার কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। তার গ্রামে বাড়ি মুন্সিগঞ্জের গাজারিয়ার বাউশিযায় একটি বগুতল ভবন রয়েছে। এছাড়া আশুলিয়া, সাভারেও তার একটি বাড়ি রয়েছে। সেখানে তার প্রথম স্ত্রী থাকেন। ঢাকায় তার একাধিক ফ্ল্যাট রয়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। তার দ্বিতীয় স্ত্রীর বাবার বাড়ি খুলনার মংলায়। সেখানেও দ্বিতল বাড়ি করেছেন বলে জানা গেছেন। কিনেছেন কয়েক কোটি টাকার জমিও। রাজধানীর লালমাটিয়ায় চার হাজার স্কয়ার ফুটের কয়েক কোটি টাকার বেশি মূল্যমানের ফ্ল্যাট রয়েছে। এটি তিনি ২০০৩ সালের দিকে কিনেছেন বলে জানা গেছে। জানা গেছে, ২০০৩ সালে তিনি ফতুল্লায় ৪ কোটি টাকা লস করে। সেখানে লস দেখিয়ে সেই টাকা দিয়ে তিনি ফ্ল্যাট কিনেছেন। এছাড়া দেশের বিভিন্নস্থানে তার জমি-জমা রয়েছে বলেও অভিযোগ করা হয়েছে। দুদকের আবেদনে বলা হয়েছে, ছাত্র জনতার গণঅভূত্থানের পর অন্তবর্তী সরকার দুনীৃতিবাজ কর্তাদের বিরুদ্ধে যেভাবে ব্যবস্থা নিচ্ছেন, তারা যেন যমুনার কর্মকর্তা জাহিদ সরওয়ারের দুনীৃতির বিরুদ্ধেও ব্যভস্থা নেন, সেটিই সর্বস্তরের কর্মকর্তা কর্মচারীদের দাবি।
অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়ে জাহিদ সরওয়ার বলেন, আমার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সঠিক নয়। সাম্প্রতিক অভিযোগের বিষয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে আমি আমার জবাব দিয়েছি। কিছু বলার থাকলে তারাই বলবে। একাধিক বাড়ি ও ফ্ল্যাটের বিষেয় তিনি বলেন, আমি দীঘদিন ধরে চাকরী করছি। আমার বাড়ি থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু না।
অভিযোগের বিষয়ে যমুনা অয়েলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুস্তফা কুদরত-ই-ইলাহি বলেন, আমি কিছুদিন হলো দায়িত্বে এসেছি। অভিযোগের বিষয়গুলো তদন্তনাধীন। তাই এখনি কিছু বলতে পারছি না। পুরো বিষয়টি জেনে আমি জানাতে পারবো।
জা ই / এনজি