বিকাল ৪:০৯ | সোমবার | ২৮শে এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ১৫ই বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, গ্রীষ্মকাল | ২৯শে শাওয়াল, ১৪৪৬ হিজরি

বিশেষ সাক্ষাৎকার: বদরুদ্দীন উমর সরকারের উচিত এ বছরের মধ্যেই নির্বাচন দিয়ে দেওয়া

বিশেষ সাক্ষাৎকার:

 

বদরুদ্দীন উমর

বদরুদ্দীন উমর লেখক-গবেষক ও বামপন্থী রাজনীতিক। ১৯৬১ সালে যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি দর্শন, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিষয়ে পিপিই ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফিরে আসেন এবং ১৯৬৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন। গভর্নর মোনায়েম খানের স্বৈরতান্ত্রিক আচরণের প্রতিবাদে ১৯৬৮ সালে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা ছেড়ে রাজনীতি এবং লেখালেখিতে আত্মনিয়োগ করেন। তাঁর লেখা পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি ভাষা আন্দোলনের ওপর প্রথম গবেষণাগ্রন্থ। প্রথম আলোর সঙ্গে তিনি কথা বলেন আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ, ছাত্রদের নেতৃত্বে গড়া নতুন দল, অন্তর্বর্তী সরকারের করণীয় ইত্যাদি বিষয় নিয়ে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসান ও মনোজ দে

বদরুদ্দীন উমর: এই যে গণ-অভ্যুত্থান হয়েছে, এটা তো কোনো সামাজিক বিপ্লব নয়, যদিও এর মধ্য দিয়ে একটা বড় পরিবর্তন হয়েছে। একটা নিষ্ঠুর ফ্যাসিস্ট সরকার অক্টোপাসের মতো দেশকে আঁকড়ে ধরেছিল, সেটা উৎখাত হয়েছে। এই অভ্যুত্থানের এটা একটা খুব বড় অর্জন।

কিন্তু এই সংগ্রামের তো কোনো শ্রেণি–পরিচয় নেই, এটা কোনো শ্রেণি–সংগ্রাম ছিল না। একটা রিগ্রেসিভ (নিপীড়নমূলক) সরকারকে ফেলে দিয়েছে এই অভ্যুত্থান। যারা ফেলে দিয়েছে, তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক তাত্ত্বিক ভিত্তি ছিল না। যারা এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে, সেই ছাত্রদের মধ্যে তত্ত্বগত বোঝাপড়া খুব একটা আছে, সেটাও দেখা যাচ্ছে না।

বদরুদ্দীন উমর: তারা সরকারি চাকরিতে কোটা নিয়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন করেছিল। কোটার বৈষম্য আর সামাজিক বৈষম্য তো এক জিনিস নয়। অথচ অনেকেই দুটি বিষয়কে এক জিনিস বলে ধরে নিয়েছে। কাজেই সামাজিক বৈষম্য বলতে, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন বলতে কী বোঝে, তার কোনো ব্যাখ্যা আমরা এখন পর্যন্ত পাইনি।

কোটার বিরুদ্ধে বৈষম্য না হয় বুঝলাম, সামাজিক বৈষম্য বলতে তারা কী বোঝে? তাদের এখন পর্যন্ত দেশের কৃষক, শ্রমিকের পক্ষে কোনো কথা বলতে শুনিনি। ছাত্ররা বলেছে, তারা বামপন্থী নয়, তারা দক্ষিণপন্থীও নয়, তারা মধ্যপন্থী। সত্যিকার অর্থে মধ্যপন্থী বলতে দুনিয়ায় তো কিছু নেই। তাদের তো বলতে হবে তারা কী, তারা কিসের জন্য দল করছে। সেটা কিন্তু দেখা যাচ্ছে না।

বদরুদ্দীন উমর: এখন তারা যেভাবে চলছে, সেটা আমার কাছে একটু অদ্ভুত মনে হচ্ছে। এই অভ্যুত্থানের পর নতুন পার্টি হলো। একটা বিরাট জাঁকজমকের সঙ্গে নতুন পার্টির অভিষেক হলো। তারা বড় বড় ইফতার পার্টি দিয়েছে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শামিয়ানা খাটিয়ে লোকজনকে ইফতার করিয়েছে। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ইফতার পার্টি দিয়েছে। আমি তো খুব বিস্মিত তাদের এই কার্যকলাপে। এটা যারা করছে, তাদের কতখানি জনসম্পৃক্ততা আছে, সেটা তো চিন্তা করার বিষয়।

এরপর তারা যেসব কথাবার্তা বলছে, তাতে খুব আশান্বিত হওয়ার কিছু নেই যে তারা খুব বিরাট কিছু করে ফেলবে। নতুন পার্টি ঠিক কী করবে, সেটা ভবিষ্যতেই দেখবে মানুষ; কিন্তু পার্টি হওয়ার পর তাদের যে পারফরম্যান্স, সেখানে এমন কিছু নেই, যেখানে বোঝা যাবে, তারা খুব একটা বড় ধরনের পরিবর্তন দেশের রাজনীতির ক্ষেত্রে আনতে পারবে।

তারা বলছে, সংবিধান পরিবর্তন করতে চায়। কী ধরনের পরিবর্তন চায়, কেন পরিবর্তন চায়, তার বিস্তারিত তো কিছু দেখছি না। একটা পার্টি হয়ে গেল, অথচ তাদের ঘোষণাপত্র, গঠনতন্ত্র নেই এখনো।

অল্পবয়স্ক ছেলেপেলে একটা পার্টি করল। তাদের প্রথম কথা হচ্ছে, কীভাবে ক্ষমতায় যাবে। তাদের ভাবখানা এমন যে তারা নির্বাচন করবে এবং নির্বাচনে জিতে সরকার গঠন করবে।

প্রশ্ন হলো, তাদের কী পরিচিতি আছে যে লোকে তাদের ভোট দেবেন। স্থানীয় বিবেচনা, রাজনৈতিক বিবেচনা—এসব দেখে লোকে ভোট দেন। তাদের তো স্থানীয় ভিত্তি বলে কিছু নেই। গ্রামাঞ্চলে তাদের রাজনৈতিক পরিচিতিও নেই।

প্রচার-প্রচারণার কারণে শহরাঞ্চলে তাদের একটা অবস্থান আছে। নির্বাচনে তাদের খুব বড় জিত হবে, সেটা আমি মনে করি না। তারা মনে করছে যে তারা এমন অবস্থানে আছে যে লোকে ভোট দিয়ে তাদের জিতিয়ে দেবেন। এসব হচ্ছে পরিস্থিতি সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল না থাকার বিপদ।

অন্তর্বর্তী সরকারের আট মাস হলো। আপনার মূল্যায়ন কী?

বদরুদ্দীন উমর: এই সরকারের একটা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তারা নিজে থেকে আসেনি। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও অন্য উপদেষ্টারা তো বলেননি যে তাঁরা সরকার গঠন করবেন। ছাত্রনেতারা ও অন্য লোকজন ধরে-বেঁধে তাঁদের সরকারে বসিয়েছে।

হাসিনার পতন হওয়ার পর একটা শূন্যতা তৈরি হয়েছিল। সেই শূন্যতা তো পূরণ হওয়ার দরকার ছিল তাড়াতাড়ি। সেখানে ছাত্র ও অন্যরা মিলে যে এ ধরনের একটা সরকার দাঁড় করিয়েছে, সেটা বাস্তব পরিস্থিতিতে একটা সঠিক কাজ হয়েছে। কারণ, সেই মুহূর্তে সরকার গঠন না করা হলে সেই শূন্যতা পূরণের ক্ষমতা ছিল সামরিক বাহিনীর। দেশে আরেকটা সামরিক শাসন আসত।

কাজেই তাদের দোষারোপ করা, উড়ে এসে জুড়ে বসেছে—অনেকে যেটা বলছেন, সেটা ননসেন্স কথাবার্তা। পরিস্থিতি না বোঝার কারণে তাঁরা এটা বলছেন। এই সরকার ক্ষমতা দখল করেছে, এটা মোটেই ঠিক নয়।

অন্তর্বর্তী সরকারের মূল দায়িত্ব কী?

বদরুদ্দীন উমর: এই দেশের শাসনকাজ পরিচালনা করার জন্য লোকজন তাঁদের বসিয়েছে, যাতে দেশে একটা স্বাভাবিক পরিস্থিতি
ফিরিয়ে আনা যায়। তাঁরা একটা সীমাবদ্ধতার মধ্যে কাজ করছেন। তাঁদের তো নিজেদের কোনো ক্ষমতা নেই।

দ্বিতীয়ত, তাদের মধ্যে শ্রেণিচিন্তা নেই। যে ব্যবসায়ী শ্রেণি আগে দেশকে পরিচালনা করছিল, এখনো তারা দেশকে পরিচালনা করছে। বাহাত্তর সাল থেকেই এই ধারা চলছে। যেখানে জাতীয় সংসদে শতকরা ৭০ জন সদস্য হলেন ব্যবসায়ী।

আগেকার দিনে ব্যবসায়ীরা রাজনীতিবিদদের মাধ্যমে কাজ করতেন। এখন রাজনীতিবিদদের তাড়িয়ে দিয়ে ব্যবসায়ীরা নিজেরাই সরাসরি রাজনীতিবিদ হয়ে সরকার নিয়ন্ত্রণ করছেন। অর্থনীতিকে তাঁরা নিয়ন্ত্রণ করছেন, রাজনীতিকে তাঁরা নিয়ন্ত্রণ করছেন। তাঁরা তো আসলে পর্দার পেছন থেকে দেশ পরিচালনা করছেন।

হাসিনা হয়তো মনে করতেন, তিনিই ছিলেন সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর। কিন্তু এখানে রবীন্দ্রনাথের সেই ‘পথ ভাবে আমি দেব রথ ভাবে আমি,’ আসলে অন্তর্যামী জানেন কে দেবতা। হাসিনা পালিয়েছেন, তাঁর লোকজন অনেকে পালিয়েছেন। সবাই তো পালাননি। তাঁরা তো এখানে রয়ে গেছেন। তাঁরাই এই দেশের শাসকশ্রেণি। সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ করছেন। ব্যবসা থেকে শুরু করে প্রশাসন, পুলিশ—সব জায়গাতে তাঁদের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে।

কাজেই সরকারের একটা দুর্বল জায়গা তো রয়েছে। তারা নির্বাচিতও নয়। তাদের নিজস্ব কোনো শক্তিও নেই। হাসিনা চলে যাওয়ার পর দেশে যে একটা নৈরাজ্যিক পরিস্থিতি তৈরি হয়নি, সে জন্য তারা কাজ করেছে। সেদিক থেকে তারা তো ভালো কাজ করেছে। তারা যে সব ঠিকঠাক করছে, তা নয়। সামগ্রিকভাবে বলা যায়, তারা ভালোই চালাচ্ছে।

শ্রমিকেরা তো বেতন বৃদ্ধির জন্য আন্দোলন করলেন। কোনো পরিবর্তন হলো কী?

বদরুদ্দীন উমর: সরকার শ্রমিকের পক্ষে দাঁড়াচ্ছে না। কারণ, ব্যবসায়ী শ্রেণি তাদের নিয়ন্ত্রণ করছে। গার্মেন্টসে মজুরির আন্দোলনে সরকার সমর্থন দিচ্ছে না। যারা শাসকশ্রেণি রয়েছে, তাদের বিরোধিতা করে সরকার শ্রমিকের মজুরি বাড়াতে পারছে না।

এসব বাদ দিয়ে সামগ্রিকভাবে যদি বিবেচনা করি, তাহলে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টির যথেষ্ট আশঙ্কা ছিল, সেটা হয়নি। এখনো অনেক ধরনের বিশৃঙ্খলা হচ্ছে, সেটা নিয়ে সবাই হইচইও করছেন। কিন্তু বিশাল আকারে নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা হতে পারত, সেটা তারা হতে দেয়নি।

আমি একজন বাস্তববাদী। আমি সরকারের অনেক সমালোচনা করি; কিন্তু একটা অসম্ভব অবস্থান থেকে সমালোচনা করতে পারি না। ফিন্যান্সিয়াল, ব্যাংকিংসহ অনেক জায়গায় তারা একটা মোটামুটি স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে এনেছে। সেটা না করলে তাহলে দেশে একটা ভীষণ অবস্থা দাঁড়াত। সমালোচনা করার আগে সেটা তো বিবেচনা করতে হবে। কেউ যদি মনে করেন, তারা একটা সমাজতান্ত্রিক কর্মসূচি নেবে, সেটা তো বাস্তব নয়। তাদের অবস্থানটা তো দেখতে হবে।

এখন সরকারের প্রধান কর্তব্য কী বলে মনে করেন?

বদরুদ্দীন উমর: সাময়িকভাবে তাদের যে পরিস্থিতি মোকাবিলার কথা ছিল, সেটা তারা করেছে। নির্বাচনের জন্য যেসব প্রস্তুতি নেওয়া দরকার, সেটা করে তাদের উচিত তাড়াতাড়ি নির্বাচন দিয়ে দেওয়া। আমি মনে করি, এ বছরের মধ্যেই তাদের কাজ শেষ করা দরকার।

সরকারের মেয়াদ বেশি দীর্ঘায়িত করা ঠিক হবে না। নির্বাচন দিয়ে নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতা দিয়ে দিতে হবে। তারপরের দায়িত্ব তাদের (নির্বাচিত সরকার)।

নির্বাচিত সরকার দেশের মানুষকে দুধেভাতে রাখবে, এমন নয়; কিন্তু একটা নির্বাচিত সরকার হয়ে গেলে তাদের একটা শক্তি থাকে, সামাল দেওয়ার যে ক্ষমতা, সেটা থাকে।

বেশি দিন যদি অস্থায়ী সরকার থাকে, দেশে নানা রকম বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে। সেটা সামাল দেওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হবে না। সব সংস্কার তাদের করতে হবে, তা তো নয়। তারা কমিশন করেছে। কমিশন রিপোর্ট দিয়েছে। সেই রিপোর্ট পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের কাজে লাগবে।

কিন্তু সেই রিপোর্ট অনুযায়ী সব সংস্কার তো অন্তর্বর্তী সরকার করতে পারবে না। সে রকম ক্ষমতা তাদের নেই। কাজেই তাদের মূল সংস্কার যেটা নির্বাচনের ব্যাপারে, সেটা করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একটা নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করাটা দরকার।

সূত্র : প্রথম আলো,/এনজি ডেস্ক / জা ই

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *