বিশেষ প্রতিবেদন
স্থানীয়রা বলছেন, ব্যস্ত দুপুরে হঠাৎ শুরু হওয়া হইচই, রাস্তাজুড়ে দৌড়াদৌড়ি, ইট ছোঁড়া কিংবা কাঁদানে গ্যাসে কাশতে থাকা সাধারণ মানুষ— সবই এখন পরিচিত দৃশ্য। তাই পুলিশ থেকে স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে এসব ঘটনা যেন একটা ‘সিজনাল ফেস্টিভ্যালে’ পরিণত হয়েছে। এর সঙ্গে মাঝেমধ্যে আবার যুক্ত হন ধানমন্ডি আইডিয়াল কলেজের শিক্ষার্থীরাও। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সংঘর্ষ, মারামারি এতটাই বেড়েছে যে, শিক্ষার্থীদের দৌড়াদৌড়ি দেখলেই এলাকাবাসী থেকে শুরু করে দোকানদার, পথচারী—সবাই যেন আগেই বুঝে ফেলেন, এবার কোন দল মারামারিতে নামবে।

তবে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, বছরের পর বছর ধরে চলা এই সংঘর্ষের কারণ বা নেপথ্যের ঘটনা প্রায়শই অজানা কিংবা আড়ালেই থেকে যায়। ফলে, কোন ঘটনাকে কেন্দ্র করে মারামারি কিংবা সংঘর্ষ শুরু হয়েছে সেটি না জেনেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়। ফলশ্রুতিতে তাৎক্ষণিকভাবে এটি লাঘব হলেও পরবর্তী সময়ে আবারও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। যা নিয়ে সম্প্রতি ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) রমনা বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মাসুদ আলমের ‘সংঘর্ষের কারণ তারা (ছাত্ররা) আর আল্লাহ্ ছাড়া কেউ জানে না’ মন্তব্যও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ ভাইরাল হয়েছে।
অবশ্য, গত কয়েক বছর ধরেই এই তিন কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে নানা ছুতোয় সংঘর্ষ লেগেই আছে। অধিকাংশ সময় ফেসবুক স্ট্যাটাস, ফুটপাতে হাঁটা, চোরাগোপ্তা হামলা, কলেজ বাস ভাঙচুর, স্লেজিং এবং বুলিংকে কেন্দ্র করে সূত্রপাত হয় মারামারির। যা জিইয়ে রেখে কয়েক দিন দফায়-দফায় ঘটে সংঘর্ষ ও মারামারি।
বিষয়টি নিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীরা মুখ খুলতে নারাজ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক শিক্ষার্থী জানান, সামান্য বিষয়কে কেন্দ্র করেই এমন সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। আর কিছু শিক্ষার্থীর জন্য সবাইকেই সমস্যার মুখে পড়তে হচ্ছে। দেখা যায়, কোনো একজন ছাত্রের ব্যক্তিগত বিরোধ, ক্রোধ অথবা ঝামেলা নানানভাবে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কলেজে নিয়ে আসা হয়। একপর্যায়ে এসে কলেজের ঝামেলা হিসেবে সড়ক পর্যন্ত গড়ায়। এর জের ধরে উভয় কলেজের ছাত্রদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
সাধারণ শিক্ষার্থীরা বলছেন, এই সংঘর্ষের কারণে নিয়মিত ক্লাস ও পরীক্ষায় অংশ নিতে দুশ্চিন্তায় পড়তে হচ্ছে। যা তাদের শিক্ষাজীবনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ভয়ে কলেজে আসা এবং যাওয়ার সময় তটস্থ থাকতে হচ্ছে। কর্তৃপক্ষের দুর্বল নজরদারি এবং পুলিশ প্রশাসন কড়াকড়ি না থাকায় এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে বলেও মন্তব্য করেছেন তারা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা কলেজের এক শিক্ষার্থী বলেন, সামান্য কিছু হলেই মারামারি লেগে যায়। আমরা সাধারণ ছাত্ররা তো ভয়ে থাকি যে কখন কী হয়। ক্লাসে যেতেও ভয় লাগে, আবার ক্যাম্পাস থেকে বের হতেও ভয় লাগে। এই মারামারির জন্য আমাদের পড়াশোনার কত ক্ষতি হচ্ছে, সেটা কেউ বোঝে না।
সিটি কলেজের আরেক শিক্ষার্থী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এসব আসলে কিছু শিক্ষার্থীর বাড়াবাড়ি। নিজেদের মধ্যে একটু ঝামেলা হলেই সেটাকে কলেজের ঝামেলা বানিয়ে ফেলে। আর এর ভুক্তভোগী হই আমরা সবাই। ঠিকমতো ক্লাস করতে পারি না, রাস্তায় বের হলে টেনশন লাগে।
এই শিক্ষার্থী আরও বলেন, আসলে মারামারির কারণগুলো অনেক সময় আমরা নিজেরাও ঠিকভাবে জানি না। হঠাৎ শুনি মারামারি শুরু হয়ে গেছে। পরে দেখি রাস্তা বন্ধ, চারদিকে শুধু ইট আর চিৎকার।
ধানমন্ডি আইডিয়াল কলেজের এক ছাত্রী বলেন, দেখেন যখন মারামারি শুরু হয়, তখন রাস্তায় একটা ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়। আমরা মেয়েরা তো আরও বেশি আতঙ্কে থাকি। কখন কার গায়ে ইট পড়ে বা ধাক্কা লাগে, সেই ভয়ে থাকি। এর একটা স্থায়ী সমাধান হওয়া দরকার।
সম্প্রতি ঢাকা কলেজ ও সিটি কলেজ শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষের কারণ
গত ১৫ এপ্রিল এবং ২২ এপ্রিল সংঘর্ষে জড়ান ঢাকা কলেজ এবং সিটি কলেজের শিক্ষার্থীরা। এর মধ্যে ১৫ এপ্রিলের সংঘর্ষের প্রকৃত কারণ এখনও অজানা। দুই কলেজের শিক্ষার্থীরাই এক পক্ষ অপর পক্ষকে দোষারোপ করে বক্তব্য দিয়েছেন।
ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের দাবি, সিটি কলেজের শিক্ষার্থীরা প্রথমে তাদের সহপাঠীদের মারধর করেছেন। যার প্রতিবাদে সবাই রাস্তায় নেমে এসেছেন। আবার ঢাকা সিটি কলেজের শিক্ষার্থীরা দাবি করছেন, ঢাকা কলেজের ছাত্ররাই আগে তাদের সহপাঠীকে মেরেছেন। সেদিন সায়েন্সল্যাব এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে হয়েছে।
পরে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) রমনা বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মাসুদ আলম বলেন, ঘটনা শুরুর প্রকৃত কারণ জানতে সময় লাগবে। তারা কী কী কারণে এটা করে, এরা (শিক্ষার্থীরা) এবং আল্লাহ্ ছাড়া আর কেউ বলতে পারবে না। আমরা ঘটনার সূত্রপাতের বিষয়টি পরে তদন্ত করে দেখব। তবে এরা মাঝেমধ্যে এই কাজ (সংঘর্ষ) করে থাকে।
সংঘর্ষ নিয়ন্ত্রণে স্ব-স্ব কলেজের শিক্ষকদের ভূমিকার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আজ শিক্ষকদের সহায়তা আমরা পেয়েছি। অনেকেই চেষ্টা করছিলেন তাদের শিক্ষার্থীদের ফিরিয়ে নিতে। তবে শিক্ষক প্রতিনিধিদের সংখ্যা আরও বেশি বড় হলে ভালো হয়। একজন বা কয়েকজন শিক্ষকের পক্ষে এত বড় সংঘর্ষ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না। তবে ভবিষ্যতে যেন এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হয় সে বিষয়ে আমরা কাজ করব।
ঠিক তার ৭ দিন পরই গত ২২ এপ্রিল (মঙ্গলবার) আবারও রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জড়ান এই দুই কলেজের শিক্ষার্থীরা। দীর্ঘ ৪ ঘণ্টা ধরে চলা এই সংঘর্ষে ছাত্র, পুলিশ, সাংবাদিকসহ ২০ জনের অধিক আহত হয়েছেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে লাঠিচার্জ, টিয়ারগ্যাস এবং সাউন্ড গ্রেনেডের আশ্রয়ও নিতে হয়েছে পুলিশকে। এর জেরে পর পর দুই দিন উভয় প্রতিষ্ঠানের ক্লাস বন্ধ রাখা হয়েছে।
পুলিশ বলছে, এ ঘটনার পেছনের কারণও স্পষ্ট নয়। ২১ এপ্রিল (সোমবার) ঢাকা কলেজের একজন শিক্ষার্থীকে মারধর করা হয়েছে। তবে কারা মারধর করেছে সেটি স্পষ্ট নয়।
রমনা বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মাসুদ আলম বলেন, গতকালের একটি ঘটনার ভুল বোঝাবুঝির পরিপ্রেক্ষিতেই আজকের সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়েছে। গতকাল ঢাকা কলেজের একজন শিক্ষার্থীকে সায়েন্সল্যাব এলাকায় মারধর করা হয়েছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা মনে করেছেন— এর সঙ্গে সিটি কলেজের শিক্ষার্থীরা জড়িত। সেই জেরেই সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়েছে।
কলেজ শিক্ষার্থীদের কাণ্ডে বিরক্ত এলাকার মানুষ ও ব্যবসায়ীরা
রাজধানীর সায়েন্সল্যাব, নিউমার্কেট এবং ধানমন্ডি এলাকায় কলেজ শিক্ষার্থীদের ধারাবাহিক সংঘর্ষে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন স্থানীয় বাসিন্দা ও ব্যবসায়ীরাও। ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া এবং মারামারির ঘটনায় প্রায়শই সাধারণ মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়ছেন এবং ব্যবসায়ীরা সম্মুখীন হচ্ছেন চরম ক্ষতির।
স্থানীয়রা বলছেন, ব্যস্ত সময়ে হঠাৎ করে রাস্তায় হট্টগোল, দৌড়াদৌড়ি এবং ইটের বৃষ্টির মতো ঘটনা সামনে আসছে। এখন এটি যেন এক পরিচিত দৃশ্য। আবার সংঘর্ষের কারণে রাস্তায় যান চলাচলও বন্ধ হয়ে যায়, যার ফলে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি ব্যবসায়ীরাও চরম ভোগান্তির শিকার হন।
নিউমার্কেট এলাকার ব্যবসায়ী হানিফ ভূঁইয়া বলেন, যেদিন এদের মারামারি হয়, সেই দিনটিই পুরো মাটি হয়ে যায়। কাস্টমারের সংখ্যা কমে যায়। দিনের শেষে বিরাট ক্ষতি হয়।
সায়েন্সল্যাব এলাকার দোকানীরা বলছেন, ব্যবসা-বাণিজ্য লাটে ওঠার জোগাড়। যখন মারামারি লাগে, তখন সব দোকানপাট বন্ধ করে দিতে হয়। কাস্টমার তো দূরের কথা, নিজের জান বাঁচানোই কঠিন হয়ে পড়ে। আগে মাঝেমধ্যে দুই-একটা ঘটনা শুনতাম, এখন তো প্রায় প্রতিদিনই লাগে।
এমন অবস্থায় প্রশাসন ও কলেজ কর্তৃপক্ষের কঠোর অবস্থানের দাবিও জানিয়েছেন তারা।
সংঘর্ষ ঠেকাতে এবার কঠোর বার্তা কলেজ ও পুলিশ প্রশাসনের
প্রশাসন কিংবা কলেজ কর্তৃপক্ষ—দুই জায়গা থেকেই কোনো স্থায়ী উদ্যোগ চোখে পড়ছে না বলে মনে করেন শিক্ষার্থীরা। কেউ কেউ মনে করছেন, কর্তৃপক্ষ যদি ক্যাম্পাস পর্যায়ে পর্যবেক্ষণ জোরদার করত, অভ্যন্তরীণ মনিটরিং ব্যবস্থা থাকত, তাহলে এমন পরিস্থিতি এড়ানো যেত। আবার পুলিশের উপস্থিতিও অনেক সময়ই সংঘর্ষ শুরুর পরে দেখা যায়। তাই তাৎক্ষণিক ব্যবস্থার বাইরেও দীর্ঘমেয়াদি সমাধান দরকার বলে মনে করছেন শিক্ষার্থীরা।
এমন অবস্থায় এবার কঠোর অবস্থানের ঘোষণা দিয়েছে কলেজ ও পুলিশ প্রশাসন। শিক্ষার্থীদের মধ্যকার সংঘর্ষ এবং সংঘাত কমাতে গতকাল বুধবার (২৩ এপ্রিল) ধানমন্ডি মডেল থানায় দীর্ঘ ৪ ঘণ্টা বৈঠক করেন ঢাকা কলেজ, ঢাকা সিটি কলেজ, ধানমন্ডি আইডিয়াল কলেজের অধ্যক্ষ এবং ডিএমপির রমনা বিভাগের ডিসি, এডিসি, ধানমন্ডি জোনের এসি ও তিন থানার ওসি।
মিটিংয়ে কী সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে— জানতে চাইলে ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যাপক পারভীন সুলতানা হায়দার জানান, আমরা কেউই চাই না কোনো কারণে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘাতময় পরিস্থিতি তৈরি হোক। তারপরও বিভিন্ন সময় অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটছে। এসব রোধে আমরা সম্মিলিতভাবে কিছু কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে— এখন থেকে কলেজে কেউ উচ্ছৃঙ্খলতা করলে তাদের তালিকা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হবে। পরে থানা পুলিশ ওই ছাত্রদের অভিভাবকসহ ডেকে এনে সতর্ক করবেন। তাতেও যদি তারা সতর্ক না হয়, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেবে। এরপরও যদি তাদের পরিবর্তন না হয়, তাহলে প্রয়োজনে কলেজ থেকে টিসি দিয়ে বহিষ্কার করা হবে। আর কলেজের অধ্যক্ষরা মিলে একটি নীতিমালা তৈরি করবে যাতে এক কলেজ টিসি দিলে অন্য কলেজ তাদের ভর্তি না করে।
তিনি আরও জানান, পুলিশ প্রশাসনসহ কলেজের অধ্যক্ষ ও দুজন করে কলেজ প্রতিনিধির সমন্বয়ে একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ খুলে আপডেট তথ্য আদান-প্রদান করা হবে। একই সঙ্গে সংঘর্ষ এড়ানোর জন্য তিনটি কলেজই ক্লাসের সময় পুনর্নির্ধারণ করবে। এরপরও যদি কোনো শিক্ষার্থী সংঘাতের পথে পা বাড়ায়, তবে তার বিরুদ্ধে কলেজ ও পুলিশ প্রশাসনের সম্মিলিত ব্যবস্থার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তিনি।
সূত্র -ঢাকা পোস্ট / এনজি