সকাল ৭:৩৯ | শনিবার | ১৯শে এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৬ই বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, গ্রীষ্মকাল | ২০শে শাওয়াল, ১৪৪৬ হিজরি

শীঘ্রই সুস্পষ্ট রোডম্যাপ না পেলে কর্মসূচি ঘোষণা : ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনে সরকারকে চাপে রাখতে চায় বিএনপি

বিশেষ প্রতিবেদন

১১ এপ্রিল ২০২৫

মোহাম্মদ জাফর ইকবাল

 

ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনে অন্তর্বর্তী সরকারকে চাপে রাখার কৌশল নিয়েছে বিএনপি। এরই অংশ হিসেবে রাজধানীসহ সারাদেশে কর্মসূচি পালন করবে দলটি। এর আগে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেল বিজয়ী প্রফেসর মোহাম্মদ ইউনূসের সাথেও বৈঠক করবে তারা। বৈঠকে নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ চাইবে বিএনপি। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সিঙ্গাপুর থেকে দেশে ফিরলেই বৈঠকটি হতে পারে বলে জানা গেছে।

এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ আজ সমসাময়িক ইস্যুতে রাজধানীর গুলশানে দলের চেয়ারপার্সনের কার্যালয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, বিভিন্ন ইস্যুতে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাতের সময় চেয়েছে বিএনপি। ড. ইউনূসের সঙ্গে আলোচনার পরই পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে দল। এই বৈঠকে তাদের প্রধান ইজেন্ডা থাকবে প্রধান উপদেষ্টার কাছ থেকে নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা। তিনি বলেন, নির্বাচন নিয়ে সৃষ্ট ধোঁয়াশা কাটাতে সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা জরুরি।

এদিকে জাতীয় প্রেস ক্লাবে নাগরিক অধিকার বাস্তবায়ন পরিষদের উদ্যোগে সংস্কার, জাতীয় নির্বাচন ও আগামীর বাংলাদেশ শীর্ষক আলোচনা সভায় বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেছেন, নির্বাচন হবে। নির্বাচন ঠেকানোর মতো সাহস কারো নেই। তবে এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন হতে হবে। এটা এখন আমরা দাবি করছি। কিন্তু আমরা প্রমাণ করে ছাড়বো ডিসেম্বরেই নির্বাচন দিতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, আপনাদের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা আছে। এই শ্রদ্ধা ভালোবাসা নষ্ট করবেন না। বিএনপিকে রাস্তায় নামতে বাধ্য করবেন না। বিএনপি রাস্তায় নামার আগেই নির্বাচন দিন। বিএনপি রাস্তায় নামলে কী হবে শেখ হাসিনার দিকে তাকান। তিনি বলেন, বর্তমানে অনেক রাজনৈতিক দল মনে করছে নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপিকে হারিয়ে তারা সরকার গঠন করবে। তাহলে নির্বাচনের বিরোধিতা করেন কেন? নির্বাচন দেন। আপনারা বিজয়ী হলে সরকার গঠন করবেন। আমরা সাধুবাদ জানাবো। প্রফেসর ইউনূসকে উদ্দেশ্য করে বলেন, আপনি তো রাজনীতির জন্য একদিনও জেল খাটেননি। নির্বাচনের জন্য সংস্কার প্রয়োজন। সেই নির্বাচনই যদি না হয় তাহলে সংস্কার কী কাজে লাগবে।

জাতীয় নির্বাচন নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের তরফ থেকে যেসব বক্তব্য আসছে, তাতে পরিষ্কার কোনো বার্তা নেই বলে মনে করছে বিএনপি। বরং দেশে নির্বাচন নিয়ে এক ধরনের ধোঁয়াশা তৈরি হচ্ছে জনমনে। এ অবস্থার অবসান চায় তারা। বিএনপি মনে করছে, নির্বাচন কেন্দ্রিক যত সংস্কার প্রয়োজন, সেগুলো সরকার এক অধ্যাদেশের মাধ্যমে করতে পারে। বাকি সংস্কার রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে পরবর্তী নির্বাচিত সংসদে করা যাবে।

জানা গেছে, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাতের পর নির্বাচনী রোডম্যাপ ইস্যুতে দলের পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করবে বিএনপি। এ ক্ষেত্রে তারা কর্মসূচি দেওয়ার কথাও চিন্তা করছে।স্থায়ী কমিটির একাধিক নেতা বলেন, বিএনপি যেহেতু এই সরকারকে নানাভাবে সহযোগিতা করছে এবং আগামীতেও করবে, সে কারণে নির্বাচনী রোডম্যাপ ইস্যুতে তারা বড় ধরনের কোনো কর্মসূচিতে যেতে চান না। বিএনপির নীতিনির্ধারকদের প্রত্যাশা, অন্তর্বর্তী সরকার দেশের বাস্তবতা, রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং বৈশ্বিক চাওয়া এসব বিবেচনায় নিয়ে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করবে। কিন্তু সরকার যদি তাতে কর্ণপাত না করে তাহলে কঠো কর্মসূচির দিকে যাবে বিএনপি।

বিএনপির একাধিক নেতা জানান, প্রধান উপদেষ্টার কাছ থেকে নির্বাচনের সুস্পষ্ট তারিখ না পেলে প্রতিটি শহর ও জেলায় সমাবেশসহ অন্যান্য কর্মসূচি আয়োজনের পরিকল্পনা করছেন তারা। নেতাদের ধারণা, সংস্কারের অজুহাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ আরও দীর্ঘায়িত করার জন্য নির্বাচন প্রক্রিয়া বিলম্বিত করার চেষ্টা চলছে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী  বলেন, আমরা অন্তবর্তী সরকারের কাছে বারবার নির্বাচনের কথা বলে আসছি। কারণ দেশের বর্তমান সংকট উত্তোরণে নির্বাচিত সরকারের কোনো বিকল্প নেই। তারই অংশ হিসেবে আমরা আবারো প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে নির্বাচনের তারিখ নিয়ে আলোচনা করার উদ্যোগ নিয়েছি। এরপর আমাদের শরিক দল ও সমমনা অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে পরামর্শ করব। তারপর আমরা জনগণের কাছে আমাদের বার্তা পৌঁছে দেবো। জনগনের চাহিদা অনুযায়ী আমরা কর্মসূচিতে যাবো।

নির্বাচন ইস্যুতে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর  এ প্রতিবেককে বলেছেন, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকের পর আমরা নির্ব্চান নিয়ে একটা ধারণা পাবো আশা করছি। তিনি বলেন, বিএনপি নির্বাচনমুখী দল। আমরা আশা করবো, যতটুকু সংষ্কার প্রয়োজন সেটা সম্পন্ন করে ডিসেম্বরের মধ্যেই সরকার নিব্যাচনের আয়োজন করবে। তিনি আরও বলেন, রাজনৈতিক সংকট সমাধান সম্ভব কেবলমাত্র নির্বাচনের স্পষ্ট রোডম্যাপের মাধ্যমেই। কারণ, তখনই কেবল রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে পারবে।

দলটির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য সেলিমা রহমান বলেন, নির্বাচন আয়োজনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ওপর শক্তিশালী চাপ সৃষ্টি করতে হবে। আমরা নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করতে সম্প্রতি বিভিন্ন জেলায় সমাবেশ করেছি। আমরা আবার রাজপথে নামব এবং ধীরে ধীরে আন্দোলন জোরদার করব।

বিএনপি নেতারা বলছেন, ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দাবি জোরালো করছে বিএনপি এবং এ বিষয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্য গঠনের বিষয়টিকে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। এই দাবি আদায়ের লক্ষ্যে দ্রুত আরো কর্মসূচি পালন করা হবে। বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ একজন নেতা বলেন, ঈদের আগে নির্বাচনের দাবিতে তারা এককভাবে কর্মসূচি পালন করেছেন। চলতি মাসে দ্বিতীয় পর্যায়ের কর্মসূচি শুরু হতে পারে। এই কর্মসূচিকে যুগপৎ আন্দোলনে রূপ দেওয়ার চিন্তা-ভাবনাও করা হচ্ছে। এতে সরকারের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি হবে বলে মনে করছেন তারা।

মহান স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, এ বছর ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে। এর প্রতিক্রিয়ায় তখন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য অস্পষ্ট। আমরা স্পষ্ট রোডম্যাপ এবং দ্রুত নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছি। এরপর বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, সালাহউদ্দিন আহমদসহ অনেক নেতাই ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দাবিতে তাদের কঠোর অবস্থান তুলে ধরেন।

নির্বাচনের বিষয়ে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম গণমাধ্যমে বলেন, সংস্কার ও বিচার ছাড়া নির্বাচন হলে সেটি মেনে নেওয়া হবে না। সম্প্রতি ফেসবুকে এনসিপির মুখ্য সংগঠক সারজিস আলমের মন্তব্যে (উত্তরাঞ্চল) অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অন্তত পাঁচ বছর ক্ষমতায় রাখার মত প্রকাশ করা হয়েছে। বিএনপি নেতাদের ধারণা, পরিকল্পিতভাবে এই বক্তব্য সামনে আনা হয়েছে। ঘুরেফিরে বিএনপিকে ঠেকানো এবং নির্বাচন বিলম্বিত করার প্রক্রিয়ার অংশ এটি। এছাড়া সম্প্রতি বিভিন্ন মহল থেকে জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানের যে দাবি উঠেছে, সেটাকেও ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখছে বিএনপি।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য সংসদ নির্বাচনের জন্য ১৭ বছর ধরে আমরা আন্দোলন করেছি। আমাদের নেতাকর্মীরা গুম-খুন ও হামলা-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। সুতরাং নির্বাচন দিতে গড়িমসি করা হলে মাঠের কর্মসূচি জোরদার করতেই হবে। তিনি আরও বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের মূল কাজ হচ্ছে জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করা। তবে এটি নস্যাতে ষড়যন্ত্রও আছে। এ ষড়যন্ত্র মোকাবেলায় রোডম্যাপ ঘোষণা না হওয়া পর্যন্ত বিএনপি রাজপথে থাকবে।

জানা গেছে, বিএনপি তিনটি ইস্যুকে প্রাধান্য দিবে। এগুলো হচ্ছে- দ্রব্যমূল্যে উর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণ, আইন-শৃঙ্খলা পরস্থিতি স্বাভাবিক রাখা এবং ন্যূনতম সংস্কার শেষে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা। এছাড়া হাসিনাসহ ফ্যাসিস্ট সরকারের সকলের বিচার নিশ্চিত করা, এখনো ফ্যাসিস্ট সরকারের যেসব দোসর বহাল তবিয়তে আছে তাদের বিতাড়ন করে বিচারের সম্মুখীন করা, বিএনপি নেতাকর্মীদের মামলা প্রত্যাহারসহ অন্যান্য ইস্যুগুলোও থাকবে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, বিএনপি মানুষের ভোটাধিকারের জন্যই তো দেড় যুগ ধরে আন্দোলন করেছে। কর্মীরা জীবন দিয়েছে, রক্ত দিয়েছে। আমরা আন্দোলন করেছি সংসদ নির্বাচনের জন্য আর কেউ কেউ চাচ্ছেন স্থানীয় নির্বাচন। তারা জানেন না এখন গর্তে লুকিয়ে থাকা আওয়ামী ফ্যাসিস্টরা স্থানীয় নির্বাচনের ফাঁকফোকর দিয়ে মাথা বের করবে। এটা অশুভ চক্রান্ত।

 

 

জা ই / এনজি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *