সকাল ৯:১৬ | শনিবার | ১৯শে এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৬ই বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, গ্রীষ্মকাল | ২০শে শাওয়াল, ১৪৪৬ হিজরি

সংগ্রামের সূবর্ণজয়ন্তী সর্বমহলের মিলন উৎসবে পরিণত

বিশেষ প্রতিবেদন

 

মোহাম্মদ জাফর ইকবাল

২০ জানুয়ারি ২০২৫

 

 

৪২৩, এলিফ্যান্ট রোড, বড় মগবাজার, ঢাকা। ঠিকানাটি দেশের অনেকের কাছেই আলোচিত। দীর্ঘদিনের পুরনো পাঁচ তলা বিশিষ্ট বিশাল ভবনটি নানা কারণে আজীবন কালের সাক্ষী হয়ে থাকবে। বাইর থেকে জীর্ণশীর্ণ ভবনটিতে হঠাৎ করেই নতুনত্বের ছোঁয়া। ভেতর থেকে বাইর, কোথাও যেন সংষ্কার ছাড়া থাকছে না। মাসাধিকাল ঠুক-ঠাক আওয়াজ ছিল নিত্যদিনকার ঘটনা। অনেকেই এটিকে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ফল বললেও ভেতরে ছিল অন্য কাহিনী। এই বিল্ডিংয়ে যে অবস্থান করছে দেশের প্রাচীনতম পত্রিকা দৈনিক সংগ্রাম, সেটিই ভবনের সংষ্কারের মূল বিষয়। ভবনের ওয়ালের ভেতর বাইরের ধসে পড়া পলেস্তারে লেগেছে নতুন বালু-সিমেন্ট। ছোয়া লেগেছে রংয়েও। পরিবর্তন হয়েছে পত্রিকাটির অনান্য আসবাবপত্রে। দিন যত এগুচ্ছিল ততই যেন ব্যস্ততা বেড়েছে। উপলক্ষ ছিল বহুল প্রচলিত দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকার ৫০ বছর তথা সূবর্ণজয়ন্তী উৎসব পালন। অপেক্ষার সমাপ্তি ছিল আজ সোমবার। এ দিন সংগ্রাম ভবনের আল ফালাহ মিলনায়তন পরিণত হয়েছিল রাজনৈতিক দলমত, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব খাতের তারকা-পেশাজীবীদের ব্যতিক্রমী এক মিলন উৎসবে।

সংবাদ মাধ্যম তথা একটি পত্রিকা হলো দেশের একটি আয়না। তথ্য প্রযুক্তির কল্যাণে যে আয়নায় মানুষ সমাজের প্রতিচ্ছবি দেখে প্রতিদিন-প্রতিমূহুত্বেই। আর দেশের প্রাচীনতম পত্রিকা দৈনিক সংগ্রাম হলো সেই ঝকঝকে, স্বচ্ছ, বিশ্বাসযোগ্য প্রথম সারির আয়না। এখানকার লেখনীতে মিথ্যা, গোজামিল, তৈল মর্দন বা কাউকে খুশি করার জন্য কোনো সংবাদ প্রকাশিত হয়না। লেখকেরা তাদের বস্তুনিষ্ঠু চমৎকার লেখনী দিয়ে, কর্মীরা তাদের শ্রম দিয়ে, সম্পাদকেরা তাদের মেধা দিয়ে সংগ্রামকে পৌঁছে দিয়েছেন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। নানা ঘাত-প্রতিঘাত উপেক্ষা করে পত্রিকাটি এখন মানুষের মনে আস্থা ও বিশ্বাস জন্মাতে পেরেছে।
গত ১৭ জানুয়ারি ছিল পতিকাটির ৫০ বছর পূর্তি তথা সূবর্ণজয়ন্তী। প্রতিষ্ঠার দিনে পত্রিকাটিতে স্থান পেয়েছে নামি দামি লেখককের লেখনী। প্রকাশিত হয়েছে দেশের রাজনীতিতে আস্থার প্রতীক হয়ে উঠা বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমানের একটি সাক্ষাৎকার। যেখানে উঠে এসেছে দেশের অতীত, বর্তমান নানা বিষয়। একইসাথে স্থান পেয়েছে ভবিষ্যতে তাদের করনীয় বিষয়াদিও।

আজ ২০ জানুয়ারি দৈনিক সংগ্রামের সূভর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে আয়োজন করা হয় আলোচনা সভার। এই আলোচনা ছিল যেন একটি গোলাপের বাগান। অনুষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন জনপ্রিয় উপস্থাপন, টিভি ব্যক্তিত্ব শরীফ বায়জিদ মাহমুদ। বিনয়ী উপস্থাপনা দিয়ে স্থান করে নিয়েছেন সবার হৃদয়ে। তাকে সহযোগিতা করেছেন ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) সভাপতি মো: শহীদুল ইসলাম। অনুষ্ঠানে প্রাণবন্ত ছিলেন আলোচনা সভার সভাপতি ও দৈনিক সংগ্রাম সম্পাদক আজম মীর শাহীদুল আহসান। কখনো অনুষ্ঠান স্থলে, আবার কখনো অতিথি বরণ করে নিতে ছুটেছেন। কারও কোনো অসুবিধা হলো কিনা সেটি দেখার জন্য তৎপর ছিলেন দৈনিক সংগ্রাম এর চীফ রিপোর্টার সামছুল আরেফীন। অনুষ্ঠনস্থলে প্রবেশে অতিথিদের বরণ করে নিতে সদা হাস্যজ্জ্ব্যল ছিলেন বার্তা সম্পাদক সাদাত হোসাইন। সংগ্রাম কার্যালয়ে প্রবেশের পর মেহমানদের পরিচয় করিয়ে দেবার পাশাপাশি কার কি লাগবে সেটি জিজ্ঞেস করেছেন পত্রিকাটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল হোসেইন চৌধুরী। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দিনব্যাপী অনুষ্ঠানকে আনন্দগণ করে রাখেন দৈনিক সংগ্রাম এর রিপোর্টারসহ অন্যরা। যে যার আমন্ত্রিত অতিথিদের ডেকে নিয়ে পরিচয় করিয়ে দিলেন অন্য গুণী মানুষের সঙ্গে।

অনুষ্ঠানের শুরু থেকেই প্রাণবন্ত ছিলেন প্রধান অতিথি, দেশের বর্তমান রাজনীতির আইকন, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান। তাকে আগেও দেখা গেছে অনেক অনুষ্ঠানে। তবে গতকালের মতো এতো প্রাণবন্ত কমই দেখা যায়। প্রচন্ড ব্যস্ততা সত্ত্বেও দীর্ঘসময় সবার সাথে হাসিমুখে ভাবের আদান প্রদান করেছেন। বক্তৃতায় তিনি রাজনীতির মারপ্যচ দিলেও গতকাল এমন সহজ সাবলীলভাবে কথা বলছিলেন, যেন সবাই তার খুব আপনজন। সংবাদকর্মীরা তার কাছে যে কত আপন সেটি তিনি আবারো প্রমাণ করলেন। গুরুত্বপূর্ণ প্রোগ্রাম থাকার কারণে তার নির্ধারিত সময়ের একটু আগে বক্তৃতা দিতে হয়েছে বলে খুবই নরম সুরে দু:খ প্রকাশ করেছেন। অনেকেই তার খুব পরিচিত হলেও যেন আজই তিনি সবার সাথে প্রথম কথা বলছেন। আসলে একজন মানুষ যখন প্রতিষ্ঠা পায়, যত ওপরে উঠে বিনয় নামের বটবৃক্ষে পরিণত হয়। এটিই যেন আমীরে জামায়াত প্রমাণ করেছেন।

দৈনিক সংগ্রামের সূবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, সম্পাদক, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, কবি, সাহিত্যিক, ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব, শিল্পদ্যোক্তা, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, ব্যাংকার, গুম হওয়ার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে গঠিত সংগঠকের নেতৃবৃন্দ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, চিত্রনায়কসহ বিভিন্ন শ্রেণী পেশার প্রতিনিধি। নিজেদের সব ব্যস্ততা পেছনে ফেলে ছুটে এসেছেন সংগ্রাম পরিবারকে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর শুভেচ্ছা জানানোর জন্য। শুধু কী তাই, যেখানে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আলোচনার জন্য অতিথিদের দাওয়াত দেয়া হয় বেলা ১০টায়, সেখানে তার আগেই বেশিরভাগ মেহমান চলে আসেন। তবে শুভেচ্ছা বিনিময় চলে রাত অবধি।
অনুষ্ঠানস্থল পরিণত হয় বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের মিলনমেলায়। আলোচনার পাশাপাশি সবাই মেতে উঠেন একে অপরের সাথে কুশল বিনিময়ে। কী বন্ধু সুলভ আচরণ প্রত্যেকের! সবাই গুণী ব্যক্তি। সবাই তাদের নিজ গুনে পরিচিত দেশে ও দেশের বাইরে। চারপাশে সবার সঙ্গে সবার ভাব বিনিময় চলেছে শেষ অবধি। অনুষ্ঠানে সবাই সবার প্রতি ছিলেন আন্তরিক, এটাই ছিল সবচেয়ে উপভোগ্য।

যাদের আগমন অনুষ্ঠানস্থলকে প্রাণবন্ত করে তোলে তাদের মধ্যে একজন ছিলেন চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের বিকাশে তার অবদান অনস্বীকার্য। তিনি চলচ্চিত্র সমিতির সভাপতিও ছিলেন। সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ ব্যানারে তিনি দীর্ঘ দিন ধরে আন্দোলন ও প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। পর্দায় তার উপস্থিতি দেখা গেলেও সচরাচর সামনা সামনি দেখা মেলা ভার। দৈনিক সংগ্রাম অনুষ্ঠানস্থলে তাকে দেখে অনেকেই তাদের প্রিয় নায়কের সাথে হাত মেলানোর পাশাপাশি ছবি উঠানো নিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠেন। তিনি সবার সাথে হাসিমুখে কুশলাদি বিনিময় করেন। আবদান মেটাতে অনেকের সাথে ছবিও উঠিয়েছেন এই জনপ্রিয় চিত্র নায়ক। অনুষ্ঠানস্থানে আরেকজন মানুষের সরব উপস্থিতি সবার নজর কেড়েছে। তিনি হলেন কিংবদন্তী ফুটবলার কায়সার হামিদ। মোহামেড়ান দলের অধিনায়ক ছিলেন দীর্ঘদিন। তিনি মেয়ে নিয়ে অনুষ্ঠানস্থলে আসেন। সংগ্রাম পরিবারকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানান এই কৃতি খেলোয়াড়। অনুষ্ঠান স্থলে আসেন বাংলাদেশ জাতীয় ব্যাডমিন্টনের সাবেক চ্যাম্পিয়ন ও বর্তমান কোচ এনায়েত উল্লাহ খান। ফুলেল শুভেচ্ছা জানান বাংলাদেশ সাম্বো ও কুরাশ এর সাধারণ সম্পাদক এবং বাংলাদেশ মার্শাল আর্ট কনফেডারেশনের সহসভাপতি মো: হুমায়ুন কবির।

যার কথা না বললে নয়, তিনি হলেন সানজিদা ইসলাম তুলি। আওয়ামী সরকারের শাসনামলে গুম হওয়া সংগঠন ‘মায়ের ডাক ’ এর সমন্বয়ক তিনি। তার আপন ভাই, বিএনপি নেতা গুম হয়েছেন। শান্ত চুপচাপ একেবারে নিটোল পদ্ম জলের মতো। নীরবে সবার খোঁজ নিচ্ছিলেন। অনেকের কাছে এসে বারবার জানতে চাইছিলেন, গুম হওয়া সদস্যদের কিভাবে খোঁজ পাওয়া যাবে এবং ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের বিচারে সহযোগিতা করতে।
গতকাল বেলা যত বাড়ছিল আস্তে আস্তে যেন জমে উঠেছিল দৈনিক সংগ্রাম এর সূবর্ণজয়ন্তী উৎসব। সংশ্লিষ্ট সবাই ছিলেন প্রাণবন্ত। এ এক অন্যরকম আনন্দ। আর ফাঁকে ফাঁকে সবাই সেলফি, গ্রুপ ছবি তুলছিলেন। আসলে এটি যেন একটি পরিবার। সবাই যেন বন্ধু। বন্ধুত্বে কোনো বয়সের ব্যবধান নেই, নেই কোনো অর্থের পরিধি। কিংবা বইয়ের কোনো অঙ্ক নয় যে হিসাব করে মিলিয়ে হয়। সিনিয়র, জুনিয়র বলে কিছু ছিল না, সবাই প্রাণ খুলে সূবর্ণজয়ন্তীতে আনন্দ করছে।

৫০ বছর পূর্তিতে দৈনিক সংগ্রাম ফুটে তুলেছে তাদের অতীত কর্মযজ্ঞ। দেশ, গণতন্ত্র, স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, স্বৈরাচার পতন, ফ্যাসিস্ট হাসিনার বিরুদ্ধে আন্দোলন, সর্বশেষ গত বছরের ছাত্র-জনতার আন্দালনে পত্রিকাটির ভূমিকা। একাধিক বিলবোর্ডের পাশাপাশি ডিজিটাল মাধ্যমে প্রামাণ্য চিত্র তুলে ধরা হয়। স্থাপন করা হয় কয়েকটি ফটো স্ট্যান্ড। ফুল, বেলুন, পোস্টার ও ব্যানার দিয়ে সাজানো হয় পুরো সংগ্রাম কার্যালয়সহ পুরো ভবন। প্রবেশদ্বারে ফুলেল শুভেচ্ছা জানিয়ে অতিথিদের বরণ করা হয়। অনুষ্ঠানটি প্রত্যক্ষ করা সবাই নিঃসংকোচ চিত্তে স্বীকার করবেন, দেশ ও সমাজ পরিবর্তনের যে প্রত্যয় নিয়ে অর্ধশত বছর আগে পথচলা শুরু করেছে দৈনিক সংগ্রাম, সেটি অনেকটাই সার্থক।

 

জা ই / এনজি

 

 

 

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *