জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
অন্তর্বর্তী সরকারের পদত্যাগ দাবিতে পয়লা ফেব্রুয়ারি লিফলেট বিতরণের মধ্য দিয়ে মাসব্যাপী কর্মসূচি শুরু করে আওয়ামী লীগ। সেই কর্মসূচির অংশ হিসেবে রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে লিফলেট বিতরণ করেন ৩১তম বিসিএসের শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তা সহকারী অধ্যাপক মুকিব মিয়া। তিনি ছাত্রলীগের সোহাগ-নাজমুল কমিটির কেন্দ্রীয় গণশিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন।
তার এমন আচরণে রীতিমতো ‘থ’ হয়ে গেছেন শিক্ষা প্রশাসনের কর্মকর্তারা। একজন সরকারি কর্মকর্তা তাও বিসিএস কর্মকর্তা একটি রাজনৈতিক দলের লিফলেট প্রকাশ্যে বিতরণ করেছেন। শুধু তাই নয়, কারও লিফলেট প্রয়োজন হলে তা সরবরাহ করতে প্রস্তুত বলেও ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে জানিয়েছেন তিনি।
৫ আগস্টের পর থেকেই অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টাসহ বিভিন্ন উপদেষ্টাদের নিয়ে নিয়মিত আপত্তিকর শব্দ প্রয়োগ করে স্ট্যাটাস দিয়েছেন সরকারি এ কর্মকর্তা। এছাড়াও তিনি ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের নিয়মিত জঙ্গি বলে ফেসবুকে পোস্ট করেন।
জানা গেছে, এমন আচরণের কারণে ইতোমধ্যে তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তার জবাবও তিনি দিয়েছে। হাসিনা সরকারে পতনের পর তাকে লালমনিরহাটের পাটগ্রামের সরকারি জসমুদ্দিন কাজী আব্দুল গণি কলেজের বদলি করলেও সেখানে যোগদান করেননি। এরমধ্যে শনিবার (১ ফেব্রুয়ারি) সকালে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে অন্তর্বর্তী সরকারের পদত্যাগ দাবিতে আওয়ামী লীগের লিফলেট বিতরণ করেন তিনি।
তার লিফলেট বিতরণের ছবি আওয়ামী লীগের ফেসবুক পেইজে পোস্ট করা হয়েছে এবং সংবাদ মাধ্যমে যে বিবৃতি পাঠানো হয়েছে সেখানে মুকিব মিয়াকে ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
এছাড়াও নিজের ফেসবুক প্রোফাইলে লিফলেট বিতরণের একাধিক ছবি ও ছাপা হওয়া নিউজ পোস্ট করেছেন মুকিব মিয়া।
জানতে চাইলে মুকিব মিয়া বলেন, আমি সজ্ঞানে এসব করছি। আমি মনে করি এ সরকার অবৈধ উপায়ে ক্ষমতা নিয়েছে। তাদের কোনো আদেশ আমি মানব না।
আ. লীগের লিফলেট বিলি : হকারদের সতর্ক করল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী
সরকারি কর্মকর্তা হয়ে একটি দলের কর্মসূচিতে কীভাবে অংশগ্রহণ করলেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ছাত্রজীবনের এই দলের কর্মী ছিলাম। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে যারা অপমান করেছে, তার ভাস্কর্য ভাঙচুর করেছে তার প্রতিবাদ করতেই এই কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছি।
এদিকে ২০১৮ সালের সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালার ৩(খ) ধারা অনুযায়ী আচরণ লঙ্ঘন উল্লেখ করে গত ২০ জানুয়ারি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ মুকিব মিয়ার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করেছে। কেন তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হবে না, তা ১০ দিনের মধ্যে জানাতে নোটিশ দিয়েছে। আত্মপক্ষ সমর্থনে তিনি ব্যক্তিগত শুনানিতে ইচ্ছুক কি না, তাও জানতে চাওয়া হয়েছে।
তার বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অবস্থান কি জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (কলেজ) মো. নুরুজ্জামান বলেন, তার বিষয়ে অনেক অভিযোগ এসেছে। আমি আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিচ্ছি। কিন্তু গত শনিবার একটি দলের লিফলেট বিতরণ করেছে এটা শুনেছি। চাকরিবিধি অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
মন্ত্রণালয়ের এমন হুঁশিয়ারি বিষয়ে মুকিব মিয়া বলেন, আমি এই সার্ভিসে ওই অর্থে নেই। অবৈধ সরকারের অবৈধ আদেশ আমি মানি না। তারা জঙ্গি স্টাইলে দেশ চালাচ্ছে। সরকার যদি মনে করে আমাকে চাকরিচ্যুত করবে করুক। আমি নিজ থেকে পদত্যাগ করব না।
আপত্তিকর পোস্ট ভরা ফেসবুক
মুকিব মিয়ার ফেসবুক প্রোফাইল ঘুরে দেখা যায়, মুকিব মিয়া ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সমর্থক। সর্বশেষ রোববার সন্ধ্যা ৬টা ১০ মিনিটে একটি পোস্ট করে তিনি অভিযোগ করেন, গত রাতে আমার বাসায় ডিবি পুলিশ আমাকে না পেয়ে ভাঙচুর করেছে। সবার দোয়া চাই, জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু।
গত শনিবার লিফলেট বিতরণে পর ফেসবুকে একটি পোস্ট করে তিনি বলেন, লিফলেট কারও প্রয়োজন হলে আমি সরবরাহ করব। মুকিব মিয়া শেখ হাসিনার সৈনিক।
লিফলেট দরকার হলে তার মোবাইল নম্বর ও ফেসবুকে মেসেঞ্জারে যোগাযোগ করতে বলা হয়। গত ২৭ মার্চ তার প্রোফাইল ছবি হিসেবে আপলোড করা শেখ হাসিনার ছবিতে লেখা বিজয় আসবেই।
চাকরিবিধি, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের নির্দেশনা অনুযায়ী, সরকারি চাকরিজীবীর সামাজিক মাধ্যমে সরকারের সমালোচনা করার সুযোগ নেই। তিনি চাকরিবিধি লঙ্ঘন করে অন্তর্বর্তী সরকারের কড়া সমালোচনা করেন।
সরকারের কঠোর সমালোচনা করে তার করা কিছু পোস্টের মধ্যে রয়েছে— আগস্টের পর ‘লোভে পাপ, পাপে ইউনূস; ‘ইউনূস বাহিনীর নির্যাতন নাৎসি হিটলারকেও হার মানায়’; ‘ইউনূসের নাৎসি বাহিনীর ছোবল থেকে রেহাই পেল না শিক্ষার্থীরা; ‘বাংলাদেশকে গৃহযুদ্ধে ঠেলে দিতে মব সংস্কৃতি চালু করেছে অবৈধ ইউনূস সরকারের উপদেষ্টারা। জাতিকে প্রস্তুত হবে। অরাজকতা রুখতে হবে’; ‘বিয়ে করতে, প্রেম করতেও ট্যাক্স দিতে হবে ইউনূসকে। কারণ সে সুদি কারবারি’; ‘ইউনূস ঠেলা সামলা; ‘জঙ্গি ইউনূসের দিন শেষ’সহ বিভিন্ন লেখা ফেসবুকে লেখেন মুকিব।
আওয়ামী লীগ সরকারের সময় টানা ১০ বছর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরে ছিলেন মুকিব। তার সহকর্মীরা জানিয়েছেন, সে সময়েও নিয়মিত আওয়ামী লীগের কর্মসূচিতে অংশ নিতেন তিনি।
সরকারি চাকরিবিধিতে যা আছে
সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা ১৯৭৯-এর ২৫(১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘সরকারি কর্মচারী কোনো রাজনৈতিক দলের বা রাজনৈতিক দলের কোনো অঙ্গসংগঠনের সদস্য হতে অথবা অন্য কোনোভাবে যুক্ত হতে পারবেন না অথবা বাংলাদেশ বা বিদেশে কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতে বা কোনো প্রকারের সহায়তা করতে পারবেন না।’ এ ধারা লঙ্ঘনের শাস্তি চাকরিচ্যুতি।
আওয়ামী লীগের পতনের পরও দলটির কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন মুকিব। এ কর্মকর্তাকে গত ৬ অক্টোবর নিরীক্ষা অধিদপ্তর থেকে হবিগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজে বদলি করা হয়। সেখানে তিনি কাজে যোগ দিয়ে একদিন চাকরি করেন বলে জানা যায়।
পরে গত ২১ অক্টোবর তাকে লালমনিরহাটের পাটগ্রামে বদলি করা হয়। জসমুদ্দিন কাজী আব্দুল গণি কলেজের অধ্যক্ষ মো. হাবিবুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেছেন, মুকিব মিয়া গত সাড়ে তিন মাসে একবারও আসেননি। তিনি অনলাইনে যোগদানের আবেদন করেছিলেন। তা গ্রহণ করা হয়। কিন্তু তিনি যোগদানের হার্ডকপি জমা দেননি। সম্প্রতি তিনি ৩ মাসের অসুস্থতাজনিত ছুটি চেয়ে আবেদন করেছেন। কিন্তু সঙ্গে চিকিৎসকের সুপারিশ, ব্যবস্থাপত্র, অসুস্থতার প্রমাণপত্র কিছুই দেননি। এর পর আর যোগাযোগ নেই।
টি আই/ এনজি