সকাল ৭:৩৪ | শনিবার | ১৯শে এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৬ই বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, গ্রীষ্মকাল | ২০শে শাওয়াল, ১৪৪৬ হিজরি

রাজনৈতিক চাপ তৈরী করতে চায় যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দলগুলো

মোহাম্মদ জাফর ইকবাল

২২ ডিসেম্বর ২০২৪

 

 

২০২৫ সালের মধ্যেই সংসদ নির্বাচন আয়োজনে অন্তর্বর্তী সরকারের উপর রাজনৈতিক চাপ তৈরী করতে চায় বিএনপিসহ যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দলগুলো। তাদের অভিযোগ, নির্বাচন নিয়ে স্পষ্ট বক্তব্য না দেওয়ায় সরকারের সঙ্গে তাদের দূরত্বও তৈরি হচ্ছে। এছাড়া দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করাসহ অর্থনীতিতে গতি আনা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও প্রশাসনে স্থিতিশীলতা আনতে অন্তর্বর্তী সরকার ব্যর্থ হয়েছে। সরকার পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছে না। আর এতে মানুষের মধ্যে সরকার সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হচ্ছে। দ্রুত নির্বাচনের দাবির পেছনে এ পরিস্থিতিকেও অন্যতম কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে। নির্বাচন যত দেরি হবে, সংকট ততই বাড়বে বলে মনে করেন বিএনপিসহ অন্যরা। এরই অংশ হিসেবে ফ্যাসিবাদবিরোধী দলগুলোর সাথে বৈঠক শুরু করেছে বিএনপি। গত শনিবার এই ইস্যুতে ১২ দলীয় জোটের সাথে বৈঠক করেছে বিএনপি। পর্যায়ক্রমে অন্যান্য দল ও জোটগুলোর সাথে বৈঠক করার কথা রয়েছে। জানা গেছে, ১২ দলের নেতারা দ্রুত নির্বাচনের দাবির সাথে একমত পোষণ করছে। তারা মনে করেন, ২০২৫ সালের মধ্যে নির্বাচন আদায় করতে না পারলে সেটা নানা কারণে আরও বিলম্বিত হতে পারে। তাই নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক চাপ তৈরি করতে হবে। এছাড়া ষড়যন্ত্রকারীদের দৈৗরত্ব আরও বাড়বে।

এদিকে ২০২৫ সালের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন চায় দেশের অন্যতম বৃহত্তর দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীও। দলটির নেতারা মনে করেন, ২০২৫ সালের মধ্যেই একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হতে হবে। ৩ থেকে ৬ মাসের মধ্যে প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে এ নির্বাচন হতে হবে।

সূত্র মতে, নির্বাচনসহ নানা বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে গত শনিবার বিএনপির লিয়াজোঁ কমিটির সঙ্গে বৈঠক করেছে ১২ দলীয় জোটের নেতারা। বৈঠকে বিএনপির পক্ষ থেকে জোট নেতাদের নিজেদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি না করে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানানো হয়। একইসঙ্গে তাদের জানানো হয়, বিএনপি চায় ২০২৫ সালের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক। এই সময়ের মধ্যেই অন্তর্বর্তী সরকার তাদের সংষ্কার কার্যক্রম শেষ করতে পারবে। এক্ষত্রে দলের পক্ষ থেকে সব ধরণের সহযোগিতার কথাও জানানো হয়। বিএনপির এই বক্তব্যের সাথে একমত পোষণ করে জোটের নেতারাও। বৈঠক শেষে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, ১২ দলীয় জোট নেতাদের সঙ্গে আমরা আলোচনা করেছি। সমমনা জোটসহ আরও যারা আছে তাদের সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার বলেন, ১২ দলীয় জোট নেতৃবৃন্দ এবং বিএনপি নেতৃবৃন্দের সঙ্গে দীর্ঘ সময় বৈঠক হয়েছে। আগামী দিনে রাজনৈতিক কর্মসূচি কী হবে তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কিন্তু কর্মসূচি চূড়ান্ত হয়নি। তিনি বলেন, আমরা দীর্ঘদিন যাবৎ ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলন করেছি। ঐক্যবদ্ধই আছি। আমাদের ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা এখনও ফুরিয়ে যায়নি। বিএনপির সঙ্গে আরও যারা রাজনৈতিক দল আছে তাদের সঙ্গে আলোচনা করেই কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।
১২ দলীয় জোটের নেতা শাহাদাত হোসেন সেলিম বলেন, আগামী নির্বাচনের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। আমরা আমাদের মতামত বিএনপিকে দিয়ে এসেছি। জোটের শরিক শীর্ষ একজন নেতা বলেন, আমাদের জোটের সবার মতামত ছিল আগামী নির্বাচন ২০২৫ সালের মধ্যে করতে হবে। সেটাকে কোনোভাবে ২০২৬ সালে নেওয়া যাবে না। তিনি আরও বলেন, বিএনপি মনে করে দেশে একটা অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টির জন্য পরিকল্পিতভাবে কিছু ঘটনা ঘটানো হচ্ছে। সেটা তারা পর্যবেক্ষণ করছে।

জানা গেছে, নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ চায় বিএনপি। সেই দাবিতে এবার মাঠে নামছে তারা। এরই ধারাবাহিকতায় আগামী ফেব্রুয়ারি থেকে সারাদেশে সভা-সমাবেশের পরিকল্পনা করছে দলটি। উদ্দেশ্যÑ গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে চাপ সৃষ্টি করে অন্তর্বর্তী সরকারকে নির্বাচনের পথে রাখা। বিএনপির নেতারা মনে করছেন, দ্রুত নির্বাচিত সরকার গঠন করা না গেলে দেশি-বিদেশি নানা ষড়যন্ত্রে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাবে।

সূত্র জানায়, গত বুধবার রাতে অুষ্ঠিত বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে দেশের চলমান পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। সেখানে বলা হয়, প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও তার সরকারের অবস্থান জনগণের চাহিদার পক্ষে। কিন্তু সরকারের কিছু ব্যক্তিবিশেষের মাঝে উচ্চাভিলাষ কাজ করছে। এ কারণে সাধারণ মানুষের মনে সরকারকে নিয়ে এক ধরনের বিভ্রান্তি কাজ করছে। এ বিভ্রান্তি দূর করা এবং সরকারকে নির্বাচনের পথে রাখা দেশের জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল হিসেবে দায়িত্ব মনে করছে বিএনপি।

বিএনপির একাধিক নেতা জানান, মহান বিজয় দিবসে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টার নির্বাচনী ধারণা এবং পরবর্তীতে তার প্রেস সচিবের তরফে সম্ভাব্য নির্বাচনের যে ধারণা দেওয়া হয়েছে, সেটিকে ‘অস্পষ্ট ও হতাশাজনক’। দলটি মনে করে, ফ্যাসিবাদীদের দেশবিরোধী নানামুখী ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় নির্বাচনই এখন সরকারের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত এবং সেদিকেই তাদের ফোকাস করা প্রয়োজন। সরকারের তরফ থেকে এখনও সুনির্দিষ্টভাবে দিনক্ষণ না বলায় প্রস্তুতি থাকা সত্ত্বেও নির্বাচনের উদ্যোগ নিতে পারছে না ইসি। তাই নির্বাচনের প্রস্তুতি এবং সরকারের ওপর রোডম্যাপের চাপ অব্যাহত রাখার অংশ হিসেবে বড় বড় সভা-সমাবেশের পরিকল্পনা করছে বিএনপি। বিএনপি এখন রাষ্ট্র মেরামতের দলীয় রূপরেখা ৩১ দফাকে নতুন করে ব্র্যান্ডিং করছে। বিভাগীয় প্রশিক্ষণ কর্মশালার পর এখন জেলাভিত্তিক কর্মশালা চলছে। এতে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি সংযুক্ত হচ্ছেন। জেলা পর্যায়ে এ কার্যক্রম শেষ হলে নির্বাচনের দাবিতে আরও সোচ্চার হবে বিএনপি। এরই অংশ হিসেবে সারাদেশে সভা-সমাবেশ করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে।

জানা গেছে, বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সম্ভাব্য কী কর্মসূচি দেওয়া যায় এ নিয়েও একাধিক নেতা বিভিন্ন প্রস্তাব দিয়েছেন। কেউ কেউ বলেছেন, সরকারের বিরুদ্ধে কঠোর কর্মসূচিতে যাওয়া উচিত হবে না। কারণ সরকার ফেল করলে সেটি হবে সামগ্রিক ব্যর্থতা। বিএনপি এ সরকারকে ব্যর্থ দেখতে চায় না। তারা চান, সরকার একটি অবাধ-সুষ্ঠু-গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা দিয়ে তাদের কাজ সম্পন্ন করুক। যে কারণে কঠোর কর্মসূচিতে যাওয়া উচিত হবে না। এ সরকার ছাত্র-জনতার আকাংখার ফসল। তারা ব্যর্থ হলে সংকট আরও ঘনীভূত হবে। এ কারণে বিএনপির উচিত হবে নির্বাচনের প্রস্তুতি এবং জনগণ যে ভোট দিতে উন্মুখ হয়ে রয়েছেন, সেটি তুলে ধরে সারাদেশে বড় বড় সমাবেশ করা।

বিএনপি নেতারা বলছেন, নির্বাচন নিয়ে তারা কোনো তাড়াহুড়া করছেন না। বরং সরকারকে তারা সহায়তা করতে চান এবং সেটা করছেনও। এজন্য সরকারকে তারা যৌক্তিক সময় দিচ্ছেন। তবে গত ১৫-১৬ বছর ধরে ভোটাধিকারবঞ্চিত জনগণ এখন যেহেতু ভোট দেওয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে রয়েছে, তাছাড়া এতদিন নির্বাচনের ওপর থেকে রাজনৈতিক দলগুলোও যেহেতু আস্থা হারিয়ে ফেলেছিল, তাই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এখন সরকারের উচিত, রাজনৈতিক দলগুলোকে আস্থায় নিয়ে সুনির্দিষ্টভাবে নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাওয়া। তাহলে দলগুলো একদিকে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে পারবে, অন্যদিকে সরকারের সংস্কার কার্যক্রমেও সহায়তা করতে পারবে। কারণ, মেয়াদের প্রায় সাড়ে চার মাস অতিবাহিত হলেও সরকার সুনির্দিষ্টভাবে কী করতে চায়, সেটা এখনও স্পষ্ট নয়। নির্বাচনের ব্যাপারে তারা এখনও সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণ করতে পারেনি, এটিই দলটির হতাশার জায়গা। কারণ বিএনপি এই সরকারকে ব্যর্থ দেখতে চায় না। বিএনপি মনে করে, নির্বাচনই এখন সরকারের প্রধান লক্ষ্য এবং নির্বাচনমুখী সংস্কারই প্রধানতম সংস্কার হওয়া উচিত। সেদিকে ফোকাস করে সরকারকে এগিয়ে যেতে হবে। এর অংশ হিসেবে নির্বাচন কমিশন এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে খুব দ্রুত আলোচনায় বসা উচিত। বিএনপি মনে করে, প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষ করে নির্বাচনের জন্য চার-পাঁচ মাস সময় প্রয়োজন। ফলে নির্বাচনের জন্য ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে চায় না দলটি। ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন হলে তাতে আপত্তি থাকবে না বিএনপির।

নির্বাচনের গুরুত্ব তুলে ধরে বিএনপি মহাসচিব বলেন, একজন উদার গণতন্ত্রপন্থি হিসেবে আমি বিশ্বাস করি অংশগ্রহণমূলক রাজনীতি, যেখানে অংশগ্রহণের জন্য সব দলের সুযোগ থাকবে- কোনো রাজনীতিকে বাদ দিয়ে নয়। রাজনৈতিক দলের প্রতি জনগণের পছন্দ বাছাই হতে হয় নির্বাচনের মাধ্যমে। এজন্যই আমরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নির্বাচন দেয়ার জন্য জোর অনুরোধ করি।

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীও প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে ২০২৫ সালের মধ্যে নির্বাচন দাবি করছে। সংগঠনটির সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক এমপি অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেছেন, প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষ করে নির্বাচন চান তারা। সংগঠনের নায়েবে আমির, সাবেক সংসদ সদস্য ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের শনিবার কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে একটি যুব সম্মেলনে বলেছেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ২০২৫ সালের মধ্যেই হতে হবে। ৩-৬ মাসের মধ্যে সব সংস্কার শেষ করে নির্বাচন হতে হবে, সেটাই জাতির প্রত্যাশা।

 

জা ই / এনজি

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *