সকাল ৭:১৮ | রবিবার | ২০শে এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৭ই বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, গ্রীষ্মকাল | ২১শে শাওয়াল, ১৪৪৬ হিজরি

যেভাবে দেশ ছেড়ে পালান বেনজীর আহমেদ

 নিজস্ব প্রতিবেদক
 ১৫ আগস্ট ২০২৪

পুলিশ বাহিনীর সবচেয়ে ‘ক্ষমতাধর’ আইজিপি ছিলেন ড. বেনজীর আহমেদ। দেশের একটি জাতীয় দৈনিকে দুর্নীতির সংবাদ প্রকাশের পর নতুন করে আলোচনায় আসেন সাবেক এ আইজিপি। দেশজুড়ে আলোচনা-সমালোচনার মধ্যেই পরিস্থিতি বুঝে দেশ ছেড়ে পালান বেনজীর। বিমানবন্দরে তাকে সহযোগিতা করেন বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য।

বেনজীর আহমেদ দেশ ছাড়ার আগে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ঠিক কী ঘটেছিল সে বিষয়ে দুটি সিসি ক্যামেরার ফুটেজ এসেছে হাতে। ফুটেজ বিশ্লেষণ করে দেখা যায় পুলিশ সদস্যদের সহায়তায় অত্যন্ত স্বাচ্ছন্দ্যে তিনি দেশ ছাড়েন।

লতি বছরের ৪ মে রাত ১১টা ৪০ মিনিট। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সিসি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা যায়, দুর্নীতির দায়ে পুলিশের সাবেক আইজিপি ড. বেনজীর আহমেদ সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সে ওঠার জন্য সিকিউরিটি চেকের জন্য যাচ্ছেন। এসময় তার সামনে ছিলেন ইউনিফর্ম পরা একজন পুলিশ সদস্য, ইউনিফর্ম ছাড়া একজন নারী পুলিশ সদস্য এবং বেনজীরের পেছনে ইউনিফর্ম পরা একজন পুলিশ সদস্য। বেনজীর আহমেদের পরনে ছিল সোনালি রঙের একটি হাফ শার্ট, ধূসর রঙের কালো প্যান্ট ও কালো জুতা। দেশ ছাড়ার সময় বেনজীরের পরিবারের কেউ সঙ্গে ছিলেন না।

যেভাবে দেশ ছেড়ে পালান বেনজীর আহমেদ

 

উড়োজাহাজে ওঠার সবশেষ নিরাপত্তা তল্লাশির সিসি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা যায়, সেখানে দায়িত্বরত আনসার সদস্যকে বডি চেক করতে না দিয়েই পাশ কাটিয়ে চলে যান সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ। যাত্রী যেই হোক না কেন সবাইকে তল্লাশি করার নিয়ম রয়েছে। অথচ ইমিগ্রেশন পুলিশের সহায়তায় বেনজীর আহমেদ এসবের ধার ধারেননি।

সেখানে দায়িত্বরত কর্মকর্তারা বেনজীরের পাসপোর্টের সিল-স্বাক্ষর দিয়ে তল্লাশি ছাড়াই পাসপোর্ট ও লাগেজ বেনজীর আহমেদের কাছে হস্তান্তর করেন। এসময় সেখানে উপস্থিত ইউনিফর্ম পরা পুলিশদের হাত নাড়িয়ে বিদায় জানান বেনজীর।

সেদিন বেনজীর আহমেদকে বিমানবন্দরে সহায়তাকারী পুলিশ সদস্যদের মধ্যে একজন নারী পুলিশ কর্মকর্তার পরিচয় শনাক্ত করা গেছে। অনুসন্ধানে জানা যায়, বেনজীরকে পালাতে সহায়তা করা ওই নারী পুলিশ কর্মকর্তার নাম শাহেদা সুলতানা। তিনি বর্তমানে র্যাবে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ও সিনিয়র সহকারী পরিচালক (অপস) হিসেবে কর্মরত।

সিসি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা যায়, বেনজীরের কাগজপত্রসহ পুলিশ কর্মকর্তা শাহেদা সুলতানা তার আগে আগে হাঁটে যাচ্ছেন।

যেভাবে দেশ ছেড়ে পালান বেনজীর আহমেদ

বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শাহেদা অনেকদিন ধরেই বেনজীরের পরিবারের আস্থাভাজন। বেনজীর যখন র্যাবের ডিজি ছিলেন তখন শাহেদা র্যাবে ছিলেন। আইজিপি হলে শাহেদা আইজিপির সেকশনে আইজিপির স্ত্রীর প্রটোকল অফিসার হিসেবে যোগ দেন। পরে যখন বেনজীর আইজিপি পদ থেকে অবসর নেন তখন তাকে আবার র্যাব সদর দপ্তরের অপারেশন উইংয়ে সিনিয়র সহকারী পরিচালক (অপস) হিসেবে পোস্টিং দেওয়া হয়। বেনজীর যখন দেশ ছেড়ে চলে যান, তখন তিনি র্যাবে কাজ করা সত্ত্বেও নিজের প্রভাব খাটিয়ে বেনজীরকে ইমিগ্রেশন পার হতে সাহায্য করেন।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এমন আলোচিত একটি ঘটনার তদন্ত শুরুর আগেই পালিয়ে গেলে সেটিকে খুব সহজভাবে মেনে নেওয়ার সুযোগ নেই। তার মতো একজন সুপরিচিত ব্যক্তি গোপনে পালিয়ে যাবে, দেশত্যাগ করবে আর বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ চিনবে না? সেটা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হবে না? এটাকে খুব সহজে মেনে নেওয়ার সুযোগ নেই।’

গত ১৪ জুলাই বেনজীর কীভাবে দেশের বাইরে গেলেন, প্রশ্ন রাখেন হাইকোর্ট। হাইকোর্ট বলেন, ব্যাংকে একলাখ টাকার জন্য গেলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। আর বেনজীর আহমেদ কোটি কোটি টাকা ব্যাংক থেকে তুলে নিয়ে গেছেন।

গত ৩১ মার্চ ‘বেনজীরের ঘরে আলাদীনের চেরাগ’ নামে দৈনিক কালের কণ্ঠ পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশ হয়। এরপর সবশেষ ৪ মে রাতে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন ও সিকিউরিটি চেক শেষ করতে দেখা যায়। কিন্তু এখন তিনি কোন দেশে আছেন তা কেউ জানেন না।

সংবাদ প্রকাশের পর বেনজীর আহমেদ ফেসবুকে দাবি করেছিলেন তিনি কখনো দুর্নীতি করেননি। এরপর একে একে তার সম্পত্তি ক্রোক হয় এবং বিদেশ যেতেও নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। তবে সবাইকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে পুলিশের প্রত্যক্ষ সহায়তায় দেশ ছাড়ার প্রমাণ মিললো সিসি ক্যামেরার ফুটেজে।

যেভাবে দেশ ছেড়ে পালান বেনজীর আহমেদ

গত ২ জুলাই পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ, তার স্ত্রী এবং দুই কন্যার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের হিসাব জমা দিতে নোটিশ দেয় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

নোটিশে বলা হয়, প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, আপনারা (বেনজীর পরিবার) জ্ঞাত আয়বহির্ভূত স্বনামে-বেনামে বিপুল পরিমাণ সম্পদ/সম্পত্তির মালিক হয়েছেন। নিজ ও আপনাদের ওপর নির্ভরশীল ব্যক্তির নামে-বেনামে অর্জিত যাবতীয় স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ, দায়-দেনা, আয়ের উৎস ও তা অর্জনের বিস্তারিত বিবরণী কমিশনে দাখিল করবেন।

এর আগে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগের বিষয়ে ২৩ ও ২৪ জুন হাজির না হয়ে আইনজীবীর মাধ্যমে অভিযোগের লিখিত বক্তব্য জমা দেয় বেনজীর পরিবার। বেনজীরকে ৬ জুন ও তার স্ত্রী এবং কন্যাকে ৯ জুন তলব করা হয়। কিন্তু তারা না এসে দুদকের কাছে সময় চেয়েছিলেন।

গত ২৩ মে সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের ৮৩টি দলিলের সম্পত্তি ও ৩৩টি ব্যাংক হিসাব জব্দের নির্দেশ দেন আদালত। গত ২৬ মে আদালত বেনজীর ও তার পরিবারের সদস্যদের নামের ১১৯টি জমির দলিল, ২৩টি কোম্পানির শেয়ার ও গুলশানের চারটি ফ্ল্যাট জব্দের আদেশ দেন। গত ২৩ মে তাদের নামীয় ৩৪৫ বিঘা (১১৪ একর) জমি, বিভিন্ন ব্যাংকের ৩৩টি হিসাব জব্দ ও অবরুদ্ধের আদেশ দেওয়া হয়। সব মিলিয়ে ক্রোক করা হয় ৬২৭ বিঘা জমি।

 

 

এএসএ/এনজি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *