সকাল ৭:২৪ | রবিবার | ২০শে এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৭ই বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, গ্রীষ্মকাল | ২১শে শাওয়াল, ১৪৪৬ হিজরি

যাত্রাবাড়ীতে সংঘর্ষ: রোহান আর মাহাদীর স্বপ্ন থেমে গেল গুলিতে

নিজস্ব প্রতিবেদক

০৪ আগস্ট ২০২৪

 

 

রোহান আহমেদ খান আর মাহাদী হাসান (পান্থ) ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে একসঙ্গে বড় হয়েছেন। রোহান বিজ্ঞান আর মাহাদী কমার্স থেকে এবার এইচএসসি পরীক্ষা দিচ্ছিলেন। কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সংঘর্ষে গত ১৯ জুলাই গুলিবিদ্ধ হন তাঁরা। রোহান মারা যান দুপুরে আর মাহাদী সন্ধ্যার আগে।

পরিবারের সদস্যরা বলছেন, তাঁরা সরাসরি কোটা আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন না। হয়তো পরিস্থিতি দেখতে গিয়েছিলেন। তবে যাত্রাবাড়ীর ঠিক কোন জায়গায় তাঁরা গুলিবিদ্ধ হন, তা পরিবারের সদস্যরা জানেন না। উদ্ধারকারী ব্যক্তিরা হাসপাতাল থেকে মুঠোফোনে তাঁদের গুলি লাগার কথা জানান।

রোহান আর মাহাদীর বাসা যাত্রাবাড়ীর দক্ষিণ দনিয়ায় কাছাকাছি দূরত্বে। মাহাদীর বাসা পাটেরবাগে আর রোহানের বাসা বায়তুস সালাম জামে মসজিদ রোডে। তাঁরা বন্ধু ছিলেন।

বুধবার দুপুরে তাঁদের বাসায় গিয়ে দেখা যায়, কলেজের পোশাক ও বইপত্র ঠিক সেভাবেই সাজানো রয়েছে। শুধু মানুষ দুজন নেই।

মাহাদী পড়তেন নারায়ণগঞ্জের সরকারি তোলারাম কলেজে। ১৯ জুলাই শুক্রবার বিকেল চারটার পর ‘একটু ঘুরে আসছি’ বলে ঘর থেকে বেরিয়েছিলেন তিনি। দুপুরে বাবা জাহাঙ্গীর হোসেন আর অনার্সে পড়া বড় ভাই মেরাজ হোসেনের সঙ্গে জুমার নামাজ পড়েন তিনি। একসঙ্গে দুপুরে খাবার খান। বিছানায় বসে বাবার পা টিপে দেন। তারপর ঘর থেকে বের হওয়ার ৪০ মিনিটের মাথায় কাজলার সালমান হাসপাতাল থেকে কেউ একজন ফোন করে জানান, মাহাদীর শরীরে গুলি লেগেছে।

মাহাদীর মা শাহীনূর বেগম এখনো বিশ্বাসই করতে পারছেন না তাঁর ছেলে নেই। তিনি জানান, পড়াশোনার পাশাপাশি দুই ছেলেই তাঁদের বাবার কাপড়ের ব্যবসায় সাহায্য করতেন। তিনি বলছিলেন, ছেলে কোটা আন্দোলনকারীদের ওপর নির্যাতনের ছবি ও ভিডিও দেখে কষ্ট পেত। নিজেও আন্দোলনে যেতে চেয়েছিল। যেহেতু পরীক্ষা চলছে, তাই নিষেধ করা হয়েছিল। তবু সে কেন গেল বুঝতে পারছেন না তাঁরা।

এই মায়ের আক্ষেপ, ‘ছেলেকে যদি আন্দোলনে যাইতে দিতাম তাহলে তো সে ভাও (পরিস্থিতি) বুঝত। সেদিন তো সে কিছু বুঝে উঠতেই পারে নাই, তাই গুলি খাইছে।’

মারা যাওয়ার সময় মাহাদীর পরনে ছিল গোলাপি রঙের একটি শার্ট, রক্তে তা কমলা হয়ে গেছে। রক্তমাখা শার্টটা না ধুয়ে সেভাবেই রেখে দিয়েছেন শাহীনূর বেগম।

মাহাদীর বাবা জাহাঙ্গীর হোসেন ছেলের পরীক্ষার প্রবেশপত্র হাতে নিয়ে বসে ছিলেন। একটু পরপর হাউমাউ করে কাঁদছিলেন। তিনি বলেন, ‘এলাকার এক হাজার মানুষের কাছে জানতে চান, সবাই বলবে আমার ছেলে খুব ভালো ছিল।’

এই বাবার কথা, ‘পুলিশ গুলি করে থাকলে কার কাছে বিচার চাইব?’ তিনি কোনো ক্ষতিপূরণও চান না। বললেন, ‘ছেলের রক্ত বিক্রি করব না।’

এই বাবা এখন প্রতিদিন পাটেরবাগ কবরস্থানে যান। ছেলের জন্য দোয়া করেন।

‘বিচার কারে দিমু?’

দনিয়া কলেজের শিক্ষার্থী ছিলেন রোহান। তাঁর বড় ভাই অনার্সে পড়া রাহাত আহমেদ খান বলেন, ‘আগে দুই ভাই ছিলাম, এখন একা হয়ে গেলাম।’

১৯ জুলাই দুই ভাই একসঙ্গেই মসজিদে নামাজ পড়তে গিয়েছিলেন। রোহানের ফোনেই স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ, মিটফোর্ড হাসপাতাল থেকে কেউ একজন গুলি লাগার কথা জানান। রোহানের গলা থেকে নিচে বুকের মাঝবরাবর গুলি লেগেছিল।

রাহাত আহমেদ জানান, নিজেদের পড়াশোনা আর বাবার মুদিদোকানে সাহায্য করতেন তাঁরা। কারও রক্ত লাগলে সংগ্রহ করে দেওয়ার জন্য চেষ্টা করতেন রোহান।

রোহান পড়াশোনার পাশাপাশি স্কাউটসের সদস্য ছিলেন। গত মার্চে বাংলাদেশ স্কাউটস ঢাকা জেলা রোভার থেকে দক্ষতা অর্জনের সনদ পেয়েছিলেন। বড় সেনা কর্মকর্তা হতে চেয়েছিলেন তিনি।

রোহানের বাবা সুলতান খান বললেন, ‘আমি মুদিদোকানদার। এলাকায় সবাই আমারে চেনে। আমরা কোনো রাজনীতি করি না। ছেলে গুলি খাইয়্যা মইরা গেছে। চাঁদপুরে কবরস্থানে থুইয়া আইলাম। ছেলেরে কে মারছে তা জানি না। কোনো মামলাও করি নাই। বিচার কারে দিমু?’

 

টি আই/ এনজি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *