সকাল ৭:৩১ | রবিবার | ২০শে এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৭ই বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, গ্রীষ্মকাল | ২১শে শাওয়াল, ১৪৪৬ হিজরি

মোর বাবাটাক পুলিশ গুলি করিয়া মারল ক্যান, চাকরি চাওয়াটা কি অপরাধ?’

নিজস্ব প্রতিবেদক, রংপুর

১৭ জুলাই ২০২৪

 

কোটা সংস্কার আন্দোলনে গতকাল মঙ্গলবার গুলিতে নিহত বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদ (২২) কোরবানির ঈদের ছুটিতে শেষবারের মতো বাড়িতে এসেছিলেন। তিন দিন পর ক্যাম্পাসে ফিরে যান। সেই কথা বলে বিলাপ করছিলেন মা মনোয়ারা বেগম।

রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে পশ্চিম দিকে ১১ কিলোমিটার দূরে মদনখালী ইউনিয়ন পরিষদের বাবনপুর নালিপাড়া গ্রাম। এটা আবু সাঈদের গ্রাম। অনেকটা আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে ওই গ্রামে গেলে সাঈদের বাড়ি দেখিয়ে দেন আমির হোসেন (৪৫)। তিনি বলেন, ‘গ্রামোত এ রকম ভালো ছেলে আরেকটা নাই।’

সাঈদের বাড়িতে তখন শোকার্ত মানুষের ভিড়। মা মনোয়ারা বেগম মাটি চাপড়ে আহাজারি করে বলছিলেন, ‘মোর বাবাটাক পুলিশ গুলি করিয়া মারল ক্যান? ও তো কাউকে মারতে যায় নাই। চাকরি চাওয়াটা কি অপরাধ? অই পুলিশ, তুই মোকে গুলি করিয়া মারলু না ক্যান? বাবাটাক না মারিয়া পঙ্গু করি থুইলেও তো দেখপের পানু হয়।’

মনোয়ারা বেগম আহাজারি করে বলেন, ‘সারাটা জেবন কষ্ট করনো। মজুর করিয়া একটা ছইলোক পড়াইনো। আশায় আছনু, বাবাটা (সাঈদ) চাকরি করলে শ্যাষ বয়সোত শান্তিমতো খামো। আশা–ভরসা সউগ শ্যাষ হয়া গেল। হামরা কেঙ্কা করি চলমো?’

পাশেই আহাজারি করছিলেন আবু সাঈদের ছোট বোন সুমি বেগম। তিনি বলেন, ‘পুলিশ ওর বুকে গুলি না চালেয়া পঙ্গু করি ফ্যালে থুইল না ক্যান? চাকরি না হউক প্রাইভেট পড়েয়া কামাই করি বুড়া মাও–বাপোক চলাইতে পারত। নিরীহ ভাইটাকে পুলিশ এতগুলা গুলি করি মারতে পারল?

হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন আবু সাঈদের বাবা মকবুল হোসেন। তিনি বলেন, ‘পুলিশ মোর ছইলটাক গুলি করি না মারিয়া ধরি নিয়া গ্যালো না ক্যান, ওমার (পুলিশের) এ্যাকনা দয়াও হইল না।’

আবু সাঈদের বড় বোন মমতা বেগম বলেন, তাঁর ভাই পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে বৃত্তি পেয়েছে। এসএসসি ও এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়ে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে ভর্তি হয়েছিলেন। এবার কলেজের শিক্ষক নিবন্ধনের লিখিত পরীক্ষা দিয়েছিলেন আবু সাঈদ। সেখানে ভালো ফলের আশা ছিল তাঁর।

প্রতিবেশী আফছার হোসেন, সোহরাব হোসেনসহ বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নিহত আবু সাঈদের পরিবার হতদরিদ্র। ৯ ভাইবোনের মধ্যে পঞ্চম ছিলেন সাঈদ। তিনি রংপুরে প্রাইভেট পড়িয়ে নিজে চলতেন, বৃদ্ধ বাবা-মাকেও চালাতেন। তাঁর উদ্যোগে এলাকায় গড়ে উঠেছে, ‘বাবনপুর স্টুডেন্ট ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন’ নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। সদস্যরা মাসিক চাঁদা দিয়ে এলাকার গরিব–দুঃখী মানুষের বিপদে পাশে দাঁড়ান। পরিবারটি কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত নয়, এ কথা সবাই বলেছেন।

প্রতিবেশী শরীফা বেগম বলেন, ‘আবু সাঈদের জন্য গ্রামের সব মানুষ কাঁদছেন। সে তো সন্ত্রাস করে নাই। গুলি করিয়া মারতে হবে কেন? যে পুলিশ নিরপরাধ ছেলেটাকে গুলি করে মারছে, তাঁর ফাঁসি চাই।’

গতকাল রাত দুইটার দিকে র‍্যাব–পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ১০টি গাড়ির বহর নিহত আবু সাঈদের লাশ তাঁর গ্রামের বাড়িতে পৌঁছে দেয়। রাত আড়াইটার দিকে নিহতের বড় ভাই আবু হোসেন বলেন, ‘সবাই বেঁচে থাকল। আমার নিরীহ ভাইটাকে পুলিশ গুলি করে মারল। এর শক্ত বিচার চাই।’

মদনখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মঞ্জু মিয়া বলেন, আবু সাঈদের পরিবারের সদস্যরা কোনো দল করেন না। তবে আওয়ামী লীগকে সমর্থন করেন। পরিবারটি খুব গরিব। ছেলেটা খুব মেধাবী ও ভালো ছিল। বৃদ্ধ বাবা-মা আশায় ছিলেন, ছেলে পড়াশোনা শেষে চাকরি করে সংসারের অভাব ঘোচাবেন। কিন্তু সেটা আর হলো না।

 

জা ই / এনজি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *