বিনোদন প্রতিবেদক
০৮ এপ্রিল ২০২৫
কেউ মারা যাচ্ছেন বারুদের গন্ধে দম বন্ধ হয়ে, কেউ আবার বোম্বিংয়ে টুকরো টুকরো, কারও মাথা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে তো, কারও শরীর মাংসের কিমা হয়ে ছড়িয়ে আছে, আবার কেউ গোলাবারুদের সঙ্গে উড়ে যাচ্ছেন আকাশে। যার সবকিছুই ঘটছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ফিলিস্তিনে। ইসরায়েলি হামলায় এখন প্রায় নিশ্চিহ্নের পথে দেশটির রাফা ও গাজা। বলতে গেলে সেখানে শুধু মানুষ নয়, কোনো প্রাণেরই জীবিত থাকা সম্ভব নয়। তারপরও জীবন্ত নরকে পরিণত হওয়া নিজ মাতৃভূমিতে টিকে থাকতে এখনো অনেক ফিলিস্তিনি খাবার, পানি, আলো, বাতাস ছাড়াই টিকে আছেন নিজেদের ভূমিতে। এবার ব্যথিত হৃদয় নিয়ে অসহায় এই ফিলিস্তিনিদের পাশে দাঁড়ালেন দেশের তারকারা।
গাজার এই নির্মমতায় ব্যথিত করেছে ঢালিউড সুপারস্টার শাকিব খানের হৃদয়। কোনো ছবি ছাড়াই ফেসবুকে তিনি লিখেছেন, ‘গাজা শুধু একটি ভৌগোলিক নাম নয়, এটি যেন আজ নির্যাতিত মানুষের প্রতীক! দুঃখজনক হলেও বাস্তবতা হচ্ছে, সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করা ছাড়া আর কিছু করতে না পারা! তাদের পাশে আছি—ভালোবাসা, সংহতি, আর শান্তির প্রত্যাশায়।’
ফিলিস্তিনিদের প্রতি গভীর আবেগ এবং ইসরায়েলি বাহিনীর প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ অভিনেতা সিয়াম আহমেদ নিজের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেক প্রশ্ন করে লিখেছেন, ‘আমি যখন এই পোস্ট লিখছি ততক্ষণে গাজার অস্তিত্ব কি মুছে গেছে? আমরা কি পারলাম না এই শহরটাকে, এই দেশটাকে বাঁচাতে? ফিলিস্তিনের এই ধ্বংসাবশেষের দায় কি আমরা কেউ এড়াতে পারব? ফিলিস্তিনের জন্য আমার মনের কান্না কখনো থামাতে পারিনি।
এরপর তিনি আরও লিখেছেন, যখন ‘জংলির গল্প লেখা হচ্ছিল তখনো পাখির জায়গায় আমি বারবার ফিলিস্তিনি শিশুদেরই কল্পনা করতাম। আমরা কি শিশুদের জন্য একটা সুন্দর পৃথিবী উপহার দিয়ে যেতে পারব না? যখন যুদ্ধবিরতি চলছিল তখনো আমি শান্তি পাচ্ছিলাম না।’
এরপর বিশ্বনেতাদের কাছে প্রশ্ন রেখে সিয়াম আরও লিখেছেন, ‘শুধু মনে হতো, এই বিরতি কতক্ষণের? কতক্ষণ এই মানুষগুলো বাঁচবে আসলে? এই যে ঈদের পরপরই তাদের ওপর নরক নেমে এলো, তার দায় কি এই পৃথিবী নেবে না? এই ওয়ার্ল্ড লিডারস, ইসলামিক স্কলারস, নোবেল লরিয়েটস, সাধারণ মানুষ, আমরা কেউ কি এড়াতে পারব এর দায়? আল্লাহ, তুমি জান্নাতের দরজা খুলে দাও। এই পৃথিবী আর গাজাবাসীর জন্য নয়। আমরা পারিনি, আমরা পারলাম না।’
গত কয়েকদিন ধরে ফিলিস্তিনিদের আর্তনাদে ভারি হয়ে আছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। সেখানকার ভয়ংকর কিছু মুহূর্তের ছবি নিয়ে অভিনেত্রী জয়া আহসানও পোস্ট দিয়েছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
এরপর তিনি লিখেছেন, ‘দক্ষিণ গাজায় ইসরায়েলি সেনারা ১৫ জরুরি চিকিৎসাকর্মীকে হত্যা করেছে। গাজায় যে নিষ্ঠুর আর হৃদয়হীন গণহত্যা ইসরায়েল চালিয়ে আসছে, এটা তারই অংশ। পৃথিবীকে তারা ফিলিস্তিনিশূন্য করার নিয়ত নিয়ে নেমেছে।’
তারপর বিশ্বনেতাদের কাছে প্রশ্ন রেখে জয়া আরও লিখেছেন, ‘বিশ্ববাসীর প্রতিবাদে ইসরায়েল ভ্রূক্ষেপ করবে না, সেটা জানি। কিন্তু বাকি বিশ্ব? বিশ্বের বড় নেতারা? এভাবে বেশুমার শিশুহত্যা, নারীহত্যা, গণহত্যা সবার চোখের সামনে চলতে থাকবে? মানুষের হৃদয়ের ওপর থেকে পর্দা সরুক। ফিলিস্তিনিরা মানুষের মতো বাঁচার সুযোগ পাক।’
চিত্রনায়িকা পূজা চেরি তো ইসরায়েলিদের ধ্বংস চেয়েই প্রার্থনা করেছেন। ফেসবুকে দুটি আর্টওয়ার্ক এবং একটি ছবি দিয়ে তিনি তুলে ধরেছেন অসহায় ফিলিস্তিনিদের বর্তমান পরিস্থিতি। এরপর বিবেকের কাছে প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে পূজা লিখেছেন, ‘এই ধ্বংসলীলার শেষ কবে প্রভু, যাদের হাত থেকে মাসুম বাচ্চাদেরও রেহাই নেই, এমন নিকৃষ্টদের আপনি ধ্বংস করে দিন প্রভু।’
এ ছাড়া চিত্রনায়িকা অপু বিশ্বাস গাজার মুণ্ডুবিহীন তিন শিশুর একটি প্রতিচ্ছবি দিয়ে লিখেছেন,‘মানবতা মারা গিয়েছে।’
চিত্রনায়িকা বুবলী ফেসবুকে গাজার ধ্বংসস্তূপের একটি ছবি দিয়ে প্রার্থনা করে লিখেছেন, ‘আল্লাহ সহায় হোন।’
বোমে উড়ে যাওয়ার একটি আর্টওয়ার্ক দিয়ে চিত্রনায়িকা তমা মির্জা লিখেছেন, ‘এটা গোটা মুসলিম দেশের মুসলমানদের শাহাদতের চিত্র।’
চিত্রনায়িকা শাবনূর তার ফেসবুকে মাটির সঙ্গে মিশে যাওয়া রাফার একটি ছবি দিয়ে লিখেছেন, ‘গাজায় ফিলিস্তিনের এই নির্মমতা মেনে নেওয়া যায় না, ইয়া আল্লাহ আপনি ফিলিস্তিনিবাসীকে হেফাজত করুন।’
চিত্রনায়ক আরিফিন শুভ গাজার ধ্বংসস্তূপের মাঝে ভাইয়ের কোলে হেঁটে চলা এক শিশুর ছবি শেয়ার করে তিনি লিখেছেন, ‘গাজার আকাশের যে ধোঁয়া আর অশ্রুর বৃষ্টি সেই নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে আমরা শুধু প্রার্থনা করতে পারি, কাঁদতে পারি, আর চিৎকার করতে পারি। এই মানুষগুলোর অপরাধ কি শুধু এই যে, তারা নিজেদের মাটিতে বাঁচতে চায়?’
অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী তার ফেসবুকে দুটি ছবি দিয়ে লিখেছেন, ‘বিপন্ন সভ্যতা…..বিপন্ন মানবতা!!!!!!!’
নির্মাতা আসিফ ইসলাম গাজার একটি ছবি দিয়ে লিখেছেন, ‘আমরা কীভাবে আশরাফুল মাখলুকাত হতে পারি? আমার মনে গভীর সন্দেহ হচ্ছে!!’
নির্মাতা আশফাক নিপুণ তার লেখায় গাজার দুটি চিত্র তুলে ধরে লিখেছেন, ‘দুইটা ভিডিও। একটা গাজায় শিশু ভাইয়ের চিৎকার করে কান্নায় প্রবোধ দিচ্ছে আরেক শিশু।
আরেকটায় গাজায় ধ্বংসস্তূপে বসে চোখে পানি নিয়ে কিছু একটা খেতে খেতে আবার কাঁদছে আরেক শিশু। এই দুই শিশুর কষ্টের অভিশাপে পাপীরা যেন শেষ হয়ে যায়! জুলুমের শেষ পরিণতি যেন দেখে যেতে পারে এই দুই শিশুসহ ফিলিস্তিনের লাখ লাখ মজলুম।’
নাট্য অভিনেত্রী কেয়া পায়েল ফিলিস্তিনের পাশে দাঁড়িয়ে লিখেছেন, ‘গাজা যখন রক্তাক্ত, তখন পৃথিবীর নীরবতা অপরাধ। নিরীহ মানুষকে হত্যা, কণ্ঠরোধ ও মানবতা ধ্বংস এটা অমানবিকতা। আই স্ট্যান্ড উথ গাজা।’ চিত্রনায়িকা মাহিয়া মাহি, অভিনেত্রী সুনেরাহ বিনতে কামাল, শবনম ফারিয়া, জিয়াউল হক পলাশ, তানজিম সাইয়ারা তটিনী, নওসাবা আহমেদ ও নাজিয়া হক অর্ষা দাঁড়িয়েছেন গাজার মানুষের পাশে।
এ ছাড়া বিধ্বস্ত গাজার ছবি দিয়ে অভিনেতা মুশফিক আর ফারহান লিখেছেন, ‘অন্ধকারের মাঝে, গাজার আলো যেন কখনো নিভে না যায়। আমি প্রত্যেক আক্রান্ত ব্যক্তির শান্তি, আরোগ্য এবং শক্তি প্রার্থনা করি।’ কর্মবিরতি নিয়ে অভিনেতা জোভান লিখেছেন, ‘মহান আল্লাহ গাজাবাসীদের হেফাজত করুক।’
এদিকে গাজার চালানো এই বর্বর হামলার প্রতিবাদে ৭ এপ্রিল নিজেদের কুমিল্লা কনসার্ট স্থগিত করেছে ব্যান্ড অ্যাশেজ।
একটি বিবৃতি দিয়ে তারা জানিয়েছে, ‘নির্মম গণহত্যার প্রতিবাদে ৭ এপ্রিল হরতালের সমর্থনে আমরা আমাদের কুমিল্লার লাকসাম পৌরসভায় কনসার্টটি স্থগিত করেছি। উল্লেখ্য, এই কনসার্টটির তারিখ প্রায় মাস দুয়েক আগে নির্ধারিত হয়েছিল। একই সঙ্গে জানিয়ে রাখি, আয়োজকরা নিশ্চয়ই সবার সঙ্গে কথা বলে এই কনসার্টের নতুন তারিখ জানিয়ে দেবে।’ ব্যান্ড আর্ক ফ্রি প্যালেস্টাইন স্লোগানে দাঁড়িয়েছে গাজার পাশে।
এ ছাড়া সংগীতশিল্পী ইমরান মাহমুদুল হ্যাশ ট্যাগ প্যালেস্টাইন, গাজা দিয়ে লিখেছেন, ‘আমরা এক হতভাগা মুসলিম জাতি কিছুই করতে পারলাম না, আমরা এই পবিত্র ভূমির মানুষগুলোর জন্য আমরা শুধু দেখেই গেলাম। আমরা মুসলিম জাতি হিসেবে লজ্জিত।’
গাজার মানুষের জন্য এর আগে ২০২৩ সালে বাংলাদেশে কনসার্টও করা হয়। ‘টু গাজা ফ্রম ঢাকা’ শিরোনামের এই কনসার্টে গান করেন সংগীতশিল্পী আহমেদ হাসান সানি, হাতিরপুল সেশনস, মুনফ্লাওয়ার প্রজেক্ট, ফিরোজ জং, মরুভূমিসহ শিল্পী মুয়িজ মাহফুজ, অভিষেক ভট্টাচার্য, শিল্পী আসির আরমান, র্যাপ গানের ব্যান্ড দল ব্ল্যাক জ্যাং, হাইওয়ে ও শিল্পী মাশা ইসলাম।
হাতিরপুল সেশনস, মুনফ্লাওয়ার প্রজেক্ট, ফিরোজ জং, মরুভূমিসহ শিল্পী মুয়িজ মাহফুজ, অভিষেক ভট্টাচার্য, শিল্পী আসির আরমান, র্যাপ গানের ব্যান্ড দল ব্ল্যাক জ্যাং, হাইওয়ে ও শিল্পী মাশা ইসলাম। এ ছাড়া ব্যান্ড দল মাকসুদ ও ঢাকা, সহজিয়া, কার্নিভাল, ইন্দালো, আর্ক, নেমেসিস ও মেঘদল গান পরিবেশনা করেন।
ফিলিস্তিনের গাজায় গণহত্যার প্রতিবাদে এর আয়োজকরা কনসার্টের টিকিট বিক্রির পুরো টাকা গাজায় যুদ্ধাহত মানুষের জন্য আর্থিক সহায়তা হিসেবে পান। যে কারণে সে সময় কনসার্টে অংশ নেওয়া কোনো ব্যান্ড দল ও শিল্পী কেউই পারিশ্রমিক নেননি। পাশাপাশি অনলাইনেও গাজার বাসিন্দাদের জন্য আর্থিক সহায়তা সংগ্রহ করা হয়।
ফিলিস্তিনের পতাকা নিয়ে দেশের তারকারা ছাড়াও গাজাবাসীর পাশে দাঁড়িয়েছেন বিশ্ব তারকারাও।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস ইসরায়েলে নজিরবিহীন হামলা চালায়। এতে ১ হাজার ২০০ জন নিহত হন বলে দাবি ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের। এ ছাড়া জিম্মি করা হয় ২৫০ জনের বেশি মানুষকে। প্রতিশোধ নিতে সেদিনই গাজায় তাণ্ডব শুরু করে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী। তাদের বেপরোয়া বোমা হামলা ও স্থল অভিযানে সেখানে ৪৮ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। তাদের মধ্যে বেশিরভাগই নারী ও শিশু। এ যুদ্ধ বন্ধে সম্প্রতি একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তির অধীন প্রায় দুই মাসের জন্য ইসরায়েলি আগ্রাসন বন্ধ ছিল। এরপর গত ১৯ জানুয়ারি সম্মত হওয়া যুদ্ধবিরতির মেয়াদ বাড়ানোর আলোচনা কয়েক সপ্তাহ ধরে ব্যর্থ হওয়ার পর ব্যাপক হামলা চালায় ইসরায়েল। এর আগে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী বিক্ষিপ্তভাবে ড্রোন হামলা চালালেও এবারের ব্যাপক পরিসরে হামলা শুরু করেছে ইহুদি এই দেশটি।
ফা আ/ এনজি