
বছরের পুরোটা সময় ভালো বিক্রি ও লাভের জন্য দুই ঈদ এবং দুর্গাপূজার অপেক্ষায় মুখিয়ে থাকেন ব্যবসায়ীরা। আসন্ন ঈদুল ফিতর ঘিরেও আশায় বুক বেঁধেছেন তারা। কেউ সঞ্চয়ের অর্থ, কেউবা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে দোকানে নতুন পণ্যের পসরা সাজিয়েছেন। ভালো বিক্রি করে লাভের আশায় দিন গুনছেন তারা।
যদিও এখনো ঈদের বেচা-বিক্রি তেমন জমে ওঠেনি। কম বিক্রি নিয়ে হতাশা রয়েছে বিক্রেতাদের। তবে তা ছাপিয়ে ব্যবসায়ীদের কাছে এখন বড় দুশ্চিন্তা হয়ে উঠেছে নিরাপত্তা। রাতে দোকানে চুরির শঙ্কা যেমন রয়েছে, তেমনই নগদ টাকা নিয়ে ঘরে ফেরার ঝুঁকিতেও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় সময় পার করছেন তারা।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, ঈদ যতই ঘনিয়ে আসবে, ততই গভীর রাত পর্যন্ত দোকান খোলা রাখতে হবে। বিক্রির পর দোকানে নগদ টাকাও বেশি থাকবে। বর্তমানে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভেঙে পড়েছে। পুলিশ অনেকটা নিষ্ক্রিয়। এ সুযোগে বিভিন্ন মার্কেটে চুরি-ডাকাতি বেড়েছে। সার্বিক পরিস্থিতিতে সবাই দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। কখন কী ঘটে যায়!
ঈদ যতই ঘনিয়ে আসবে, ততই গভীর রাত পর্যন্ত দোকান খোলা রাখতে হবে। বিক্রির পর দোকানে নগদ টাকাও বেশি থাকবে। বর্তমানে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভেঙে পড়েছে। পুলিশ অনেকটা নিষ্ক্রিয়। এ সুযোগে বিভিন্ন মার্কেটে চুরি-ডাকাতি বেড়েছে।- বলছেন ব্যবসায়ীরা
রাজধানীর বাড্ডার সুবাস্তু নজর ভ্যালি শপিংমল, হল্যান্ড সেন্টার শপিং কমপ্লেক্স, লুৎফুন শপিং কমপ্লেক্সসহ বাড্ডা এলাকার বেশ কয়েকটি বড় মার্কেট ঘুরে দোকানমালিকদের সঙ্গে কথা বলে এমন আশঙ্কার কথা জানা গেছে।
তবে মার্কেটগুলোতে সক্রিয় থাকা কমিটি বা সমিতির নেতারা অবশ্য ভিন্ন কথা বলছেন। তাদের ভাষ্য, সম্প্রতি চুরি-ডাকাতির ঘটনাগুলোর কারণে পুলিশ প্রশাসন বেশি সক্রিয়। তারা টহল টিম দিচ্ছেন। থানা থেকেও নিয়মিত ফোন করে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। ফলে নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা নেই। একই কথা বলছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও।
চুরি-ডাকাতি-আগুনের শঙ্কা, সজাগ দোকানি-বিক্রেতা
বৃহস্পতিবার দুপুর সাড়ে ১২টা। মধ্যবাড্ডার হল্যান্ড সেন্টার শপিং কমপ্লেক্সের দ্বিতীয় তলায় কাপড়ের দোকানগুলোতে ঘুরছিলেন ২৮-৩০ বছর বয়সী এক যুবক। কয়েক দফায় তিনি ঘুরলেও কোনো দোকানে প্রবেশ করছিলেন না। দেখছিলেন না কোনো কাপড় কিংবা পণ্যও। তার গতিবিধিতে ব্যবসায়ীদের সন্দেহ বাড়ে। হঠাৎ তাকে ডেকে নাম-পরিচয় ও ঘোরাঘুরির কারণ জানতে চান, যা নিয়ে বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন ওই যুবক ও ব্যবসায়ীরা।
ঘটনার পর বিষয়টি নিয়ে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঈদের আগে মার্কেটে চুরি-ডাকাতি বেড়ে যায়। দিনে রেকি করে যায় অনেকে। রাতে অভিনব কৌশলে চুরি করে। আবার দুষ্কৃতকারীরা আগুনের ঘটনাও ঘটাতে পারে। এজন্য তারা সজাগ ও সতর্ক।
মার্কেটে সারারাত সিকিউরিটি গার্ড থাকে। তারপরও ভয়ে আমাদের ঘুম হারাম। ঈদ এলে এ ভয়টা আরও বাড়ে। আর এবার তো চারদিকে চুরি-ছিনতাই-ডাকাতি। এসব দেখে-শুনে আমরা রীতিমতো অসুস্থ হয়ে পড়ছি।- জুয়েলারির বিক্রেতা স্বাধীন খান
হল্যান্ড সেন্টারের জেসি শাড়ি সমাহারের ম্যানেজার ফজলুর রহমান বলেন, ‘বয়সে ইয়াং, ফিটফাট চোর বেশি। ওরা মার্কেটে ঘুরে ঘুরে রেকি করে যায়। কোন দোকান কোথায়, কীভাবে ঢোকা যাবে দেখে। অনেকে তো আবার টয়লেট বা কোথাও লুকিয়ে থেকে মার্কেট বন্ধ হলে চুরি করে আবারও লুকিয়ে পড়ে। সকালে বেরিয়ে যায়। চোর ধরার উপায় থাকে না।’
লেটেস্ট ফ্যাশনের মালিক মো. শান্ত বলেন, ‘বিক্রি কম হওয়া ভালো। কিন্তু ডাকাতি বা চুরি হয়ে গেলে নিঃস্ব হয়ে যাবো। বিক্রি কম নিয়ে দুশ্চিন্তা নেই। দুশ্চিন্তাটা হলো চুরি-ডাকাতি নিয়ে। তাছাড়া আগুন লাগা নিয়েও সবাই ভীত-সন্ত্রস্ত।’
তিনি বলেন, ‘দিনে ৫-১০ হাজার টাকা যা-ই বিক্রি করি, রাত ১১-১২টার দিকে তো সঙ্গে নিয়ে বাসায় যাওয়া যায় না। দোকানে রাখলে তো তাও একটা নিরাপত্তা থাকে। বাইরে টাকা নিয়ে বের হয়ে বাসায় যেতে পথে তো কোনো নিরাপত্তাই নেই। যখন-তখন বিপদ ঘটতে পারে।’
বড় মার্কেটগুলোতে সবসময় পুলিশি টহল অব্যাহত রাখা হচ্ছে। কোনো মার্কেট সমিতির পক্ষ থেকে অতিরিক্ত ফোর্স চাওয়া হলে তা দ্রুত দেওয়া হচ্ছে। ঈদের কেনাকাটা ও উৎসব উদযাপন নির্বিঘ্ন করতে আমরা তৎপর আছি। যেকোনো ধরনের সেবা দিতেও প্রস্তুত।- বাড্ডা থানার ওসি মো. সাইফুল ইসলাম।
হল্যান্ড সেন্টারের মতো সুবাস্তু নজর ভ্যালির দোকান মালিক ও বিক্রেতাদেরও একই আশঙ্কা। কাপড়, জুতা, কমমেটিকসের চেয়ে বেশি উৎকণ্ঠায় জুয়েলারির মালিকরা। সম্প্রতি বনশ্রীতে গুলি করে স্বর্ণ ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনা তাদের মুখে মুখে। ভীত-সন্ত্রস্ত জুয়েলারি মালিকরা দোকানের আশপাশের ছবি তুলতেও দিচ্ছেন না। গণমাধ্যমের কর্মীদেরও ছবি-ভিডিও নিতে বারণ এবং নিলেও তা প্রচার-প্রকাশ না করতে অনুরোধ করছেন।
সুবাস্তু নজর ভ্যালির আল-আমিন জুয়েলারির বিক্রেতা স্বাধীন খান বলেন, ‘মার্কেটে সারারাত সিকিউরিটি গার্ড থাকে। তারপরও ভয়ে আমাদের ঘুম হারাম। ঈদ এলে এ ভয়টা আরও বাড়ে। আর এবার তো চারদিকে চুরি-ছিনতাই-ডাকাতি। এসব দেখে-শুনে আমরা রীতিমতো অসুস্থ হয়ে পড়ছি। দোকানের ছবি-ভিডিও নিতে দিচ্ছি না। কারণ এগুলো ব্যবহার করে চোর-ডাকাতরা অপকর্ম ঘটাতে পারে।’
নিরাপত্তা নিশ্চিতে মার্কেট সমিতির যত উদ্যোগ
নিরাপত্তা নিয়ে দোকান মালিকদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা অমূলক নয় বলে মনে করছেন মার্কেট সমিতির নেতা ও পরিচালনা কমিটি। তারা সম্ভাব্য সব ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছেন। নিজস্ব নিরাপত্তা প্রহরী, স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের টহলদল ছাড়াও বড় অংকের টাকা নিয়ে ব্যবসায়ীরা কোথাও যেতে চাইলে নিরাপত্তায় পুলিশ প্রহরার ব্যবস্থা করে দিচ্ছে। রাতে মার্কেট শাটডাউন বা বন্ধ হওয়ার পর প্রত্যেক ফ্লোরে, প্রত্যেক গলিতে অন্তত একজন করে নিরাপত্তা প্রহরী রাখা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সমিতির নেতারা।
হল্যান্ড সেন্টার শপিং কমপ্লেক্স মার্কেট কমিটির ব্যবস্থাপক বি এইচ লিপন বলেন, ‘ঈদ ঘিরে আমরা সিকিউরিটি সিস্টেম আরও স্ট্রং করেছি। রাতে সব দোকান বন্ধের পর পুরো মার্কেট অন্তত দুইবার চেকআপ করা হচ্ছে। কোথাও কোনো দুষ্কৃতকারী লুকিয়ে আছে কি না, কোনদিকে খোলা বা সহজে প্রবেশের সুযোগ থেকে গেলো কি না এবং আগুন ছড়াতে পারে যেসব কারণে সেগুলো বারবার চেক করা হচ্ছে।’
একই রকম উদ্যোগের কথা জানিয়েছেন সুবাস্তু নজর ভ্যালি শপিংমলের সিকিউরিটি ইনচার্জ (প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা) অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা মো. একরামুল হক। তিনি বলেন, ‘এ মার্কেটে গত ১৪ বছরে কাজের অভিজ্ঞতায় দেখছি, চুরি-ডাকাতি হয়নি। এবার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কিছুটা খারাপ। সবার মধ্যে চাপা ভয় আছে। তবে আমাদের এখানে প্রবেশ ও বের হওয়ার দুটি গেট। পুরো মার্কেটে সিকিউরিটি ব্যবস্থা ভালো। প্রত্যেক ফ্লোরে এক-দুজন করে গার্ড রাতে নির্ঘুম পাহারা দিচ্ছেন।’
‘আশা করি, মুসিবত হবে না। আর কেউ বড় অংকের নগদ টাকা নিয়ে কোথাও যেতে চাইলে নিরাপত্তা প্রহরী ও পুলিশ দেওয়ার বিষয়টি ঘোষণা দিয়ে রেখেছি। সহায়তা চাইলে সঙ্গে সঙ্গে সহায়তা পাবেন।’
লুৎফুন শপিং কমপ্লেক্সের মার্কেট কমিটির সভাপতি আমিনুর রহমান বলেন, ‘আমরা পর্যাপ্ত নিরাপত্তা রেখেছি। দোকানিরা দোকানে ক্যাশ রেখে গেলেও নিরাপদে থাকবে আশা করি। ভয় কাটিয়ে আমাদের ব্যবসায় মনোযোগ দিতে হবে।’
নিরাপত্তার প্রশ্নে কঠোর পুলিশ, যেকোনো সেবায় প্রস্তুত
রাজধানীর সব এলাকায় ঈদ ঘিরে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাইসহ যেকোনো অপরাধ ঠেকাতে কঠোর অবস্থানে রয়েছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)। বাড্ডা এলাকায়ও ঈদের কেনাবেচা নির্বিঘ্ন করতে কাজ করছে ডিএমপির বাড্ডা থানা ও জোনের দায়িত্বরত কর্মকর্তারা।
মার্কেটগুলো ঘুরেও তার সত্যতা পাওয়া গেছে। সব মার্কেটে পুলিশের টহল দল রাখা হয়েছে। ফটকের সামনে বসে যেমন পাহারা দিচ্ছে, তেমনই ঘণ্টায় ঘণ্টায় পুরো মার্কেটে ঘুরে নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে খোঁজও নিচ্ছেন পুলিশ সদস্যরা।
সুবাস্তু নজর ভ্যালিতে বৃহস্পতিবার দুপুরে দায়িত্বরত ১৮ জন পুলিশ সদস্য তিনটি টিমে ভাগ হয়ে টহল দিতে দেখা যায়। তাদের নেতৃত্বে থাকা বাড্ডা থানার সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘মার্কেটের নিরাপত্তায় শিফটিং করে পুলিশের টহল টিম সবসময় অবস্থান করছে। ক্রেতা-বিক্রেতাদের যেকোনো সমস্যায় আমরা সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিচ্ছি।’
বাড্ডা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘সুবাস্তু, হল্যান্ড, লুৎফুন শপিংমলসহ আরও কয়েকটি বড় মার্কেটেও সবসময় পুলিশি টহল অব্যাহত রাখা হচ্ছে। এছাড়াও বিভিন্ন পয়েন্টে পুলিশের টহল রয়েছে। কোনো মার্কেট সমিতির পক্ষ থেকে অতিরিক্ত ফোর্স চাওয়া হলে তা দ্রুত দেওয়া হচ্ছে। নগরবাসীকে নির্বিঘ্নে ঈদে কেনাকাটা ও উৎসব উদযাপনে আমরা তৎপর আছি। যেকোনো ধরনের সেবা দিতেও প্রস্তুত।’
জেলা প্রশাসক (ডিসি) অফিসের নির্দেশনায় ব্যবসায়ীদের চলাচল ও লেনদেনেও নিরাপত্তা দেওয়া হচ্ছে বলে জানান ডিএমপির বাড্ডা জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) এইচ এম শফিকুর রহমান।
তিনি বলেন, ‘এবার ডিসি অফিস থেকে আমাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে কোনো ব্যবসায়ী লেনদেন করতে মার্কেট থেকে বের হলেও তাকে নিরাপত্তা প্রহরা দিতে হবে। অনেক মার্কেটের পক্ষ থেকে আমাদের কাছ থেকে এমন সেবা চাওয়া হচ্ছে। আমরা সঙ্গে সঙ্গে তাদের সেই সেবা দেওয়ার ব্যবস্থা করছি। আশা করি, ঈদে বাড্ডা অঞ্চলের মার্কেটগুলোতে কোনো ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটবে না। যদি কোনো চক্র অপকর্ম করে তাদের চিহ্নিত করে গ্রেফতার করা হবে।’
টি আই/ এনজি