বাংলাদেশ বিনিয়োগ বোর্ডের (বিডা) আয়োজনে চারদিনব্যাপী বাংলাদেশ বিনিয়োগ সম্মেলন-২০২৫ এর আজ বৃহস্পতিবার (১০ এপ্রিল) পর্দা নামছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এবারই প্রথম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, নেদারল্যান্ড, জার্মানি, ইউএইসহ রেকর্ডসংখ্যক ৪০টি দেশের খ্যাতনামা বিনিয়োগকারীরা এতে অংশ নিয়েছেন। পাশাপাশি দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়িক নির্বাহী ও নীতি নির্ধারকরাও এতে অংশ নেন।
সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে বিশ্বখ্যাত নামিদামি ব্র্যান্ড ইন্ডিটেক্স গ্রুপ, ডিপি ওয়ার্ল্ড, জিওডারনো ও এক্সিলারের এনার্জিসহ কোম্পানির অনেক বিনিয়োগকারী রয়েছেন। এরই মধ্যে বিভিন্ন দেশের বিখ্যাত বিনিয়োগকারী কোম্পানির শীর্ষ নীতি নির্ধারকরা বাংলাদেশে বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। কেউ কেউ এক ধাপ এগিয়ে বিনিয়োগ চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই করেছেন। আন্তর্জাতিক মহাযান সংস্থা নাসার সঙ্গে চুক্তির বিষয়টিও বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রদের নতুন দল এনসিপির শীর্ষ নেতারা বিনিয়োগ সম্মেলনে অংশ নিয়ে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগের সুষ্ঠু পরিবেশের জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকবে বলে আশ্বস্ত করেছেন।
এবারের সম্মেলনের মূল উদ্দেশ্য বাংলাদেশ সম্পর্কে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিনিয়োগকারীদের মধ্যে যে নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হয়েছে তা কাটিয়ে ওঠে ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি করা।- বিডা চেয়ারম্যান
চারদিনব্যাপী এ সম্মেলনের তৃতীয় দিন ৯ এপ্রিল সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিশ্বকে বদলে দিতে বাংলাদেশে ব্যবসা নিয়ে আসার জন্য বিনিয়োগকারীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
বিনিয়োগ সম্মেলনটি শুধু দেশেই নয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়ও ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে। সম্মেলনের শেষ দিনে এসে বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষের মনে প্রশ্ন, বহুল আলোচিত এ বিনিয়োগ সম্মেলনের প্রাপ্তি কতটুকু? সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে কত মিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে? যদিও বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিকুর রহমান বিনিয়োগ প্রতিশ্রুতি পাওয়া-না পাওয়ার হিসাব-নিকাশ নিয়ে মোটেই উদ্বিগ্ন নন।
তিনি বলেছেন, বাংলাদেশ সম্পর্কে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ নেতিবাচক ধারণা পোষণ করে। বিনিয়োগকারীদের অনেকেই মনে করেন বাংলাদেশে বিনিয়োগের মোটেও পরিবেশ নেই। তাদের এই মনে করার পেছনে যৌক্তিক কারণও রয়েছে। অতীতের সরকারের আমলে অনেক বিনিয়োগকারী এদেশে বিনিয়োগের ইচ্ছা নিয়ে এলেও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং নানা হয়রানি ও অসহযোগিতার কারণে ফিরে গেছেন।
বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বেশি বেশি বাংলাদেশে নিয়ে আসতে হবে। এক্ষেত্রে বৃহত্তর পরিসরে না হলেও ক্ষুদ্র পরিসরে সম্মেলনের আয়োজন করতে হবে।- মত বিদেশি বিনিয়োগকারীদের
‘ফলে এবারের সম্মেলনের মূল উদ্দেশ্য বাংলাদেশ সম্পর্কে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিনিয়োগকারীদের মধ্যে যে নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হয়েছে তা কাটিয়ে ওঠে ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি করা’- বলেন বিডা চেয়ারম্যান।
আশিক চৌধুরীর ভাষায়, সম্মেলন শেষে অংশগ্রহণকারী বিদেশি বিনিয়োগকারীরা যেন বাংলাদেশ সম্পর্কে ৩৬০ ডিগ্রি ভিউ (অর্থাৎ দেশের সামাজিক অর্থনৈতিক রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক প্রযুক্তিগত ভৌগলিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ইত্যাদি নিয়ে একটি সমন্বিত, বিস্তৃত ও ভারসাম্যপূর্ণ চিত্র উপস্থাপন) নিয়ে ফিরে যান, এটিই এবারের বিনিয়োগ সম্মেলনের মূল উদ্দেশ্য।
৯ এপ্রিল বিনিয়োগ সম্মেলন ২০২৫ এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের উপস্থিতিতে আশিক চৌধুরী আগামী ১০ বছর পর বাংলাদেশ কীভাবে বিনিয়োগের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হবে সে সম্পর্কে একটি তথ্যপূর্ণ উপস্থাপনা বিনিয়োগকারীদের সামনে তুলে ধরেন। এর আগে সম্মেলন উপলক্ষে আয়োজিত প্রেস ব্রিফিংয়েও তিনি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলেছেন, বিনিয়োগ সম্মেলনের তাৎক্ষণিক প্রাপ্তিতে তিনি বিশ্বাসী নন। আগামী ১০-১৫ বছর পর এ সম্মেলনের ফলাফল পাওয়া যাবে।
বিনিয়োগ সম্মেলন প্রসঙ্গে গণমাধ্যমকর্মীদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী বিনিয়োগকারীরা চট্টগ্রাম ও ঢাকায় বিভিন্ন অর্থনৈতিক অঞ্চল পরিদর্শন করেছেন। তারা বিভিন্ন ফ্যাক্টরির কর্মকর্তাদের কাছ থেকে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সমস্যা ও সম্ভাবনার কথা জেনেছেন।
বিনিয়োগ সম্মেলনের তাৎক্ষণিক প্রাপ্তিতে বিশ্বাসী নয় বিডা। আগামী ১০-১৫ বছর পর এ সম্মেলনের ফলাফল পাওয়া যাবে
‘এবারের সম্মেলনে যেসব বিনিয়োগকারী এসেছেন তাদের তালিকা তৈরি করে আগামী ৬ থেকে ১৮ মাস নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষার মাধ্যমে বাংলাদেশে বিনিয়োগের ব্যাপারে উৎসাহিত ও অনুরোধ করা হবে।’
বিডা চেয়ারম্যান বিভিন্ন দেশের বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে জানতে চেয়েছিলেন বাংলাদেশে বিনিয়োগ বাড়াতে আর কী কী করতে হবে। জবাবে অধিকাংশই একমত দিয়েছেন যে, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বেশি বেশি বাংলাদেশে নিয়ে আসতে হবে। এক্ষেত্রে বৃহত্তর পরিসরে না হলেও ক্ষুদ্র পরিসরে সম্মেলনের আয়োজন করতে হবে।
বিনিয়োগ সম্মেলনে উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটনা
১. আগামী মাসে চীন থেকে ২০০ জনের একটি ব্যবসায়িক প্রতিনিধিদল বাংলাদেশে আসবে। তারা বিনিয়োগ বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা বলবে।
২. মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম সম্পদশালী দেশ সৌদি আরবভিত্তিক প্রযুক্তিনির্ভর সরবরাহকারী কোম্পানি ‘সারি’র সঙ্গে একীভূত হয়ে নতুন কোম্পানি গঠন করেছে বাংলাদেশের বি-টু-বি স্টার্টআপ কোম্পানি ‘শপআপ’। নতুন এ কোম্পানির নাম দেওয়া হয়েছে ‘সিল্ক’ গ্রুপ। নতুন গ্রুপ গঠনের পরপরই ১১০ মিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ পেয়েছে শপআপ।
৩. বাংলাদেশের বাজারে দীর্ঘমেয়াদে থাকার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছেন হোলসিম গ্রুপের নির্বাহী কমিটির সদস্য এবং এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকা অঞ্চলের প্রধান মার্টিন ক্রিগনার।
৪. চীন ও ভারতের মতো বাংলাদেশে মার্ট চালু করার পরিকল্পনা করছে সংযুক্ত আরব আমিরাতভিত্তিক বন্দর পরিবহনকারী প্রতিষ্ঠান ডিপি ওয়ার্ল্ড। এর মাধ্যমে কার্ড মার্বেল কৃষিপণ্যসহ বাংলাদেশের পণ্য বিশ্ববাজারে তুলে ধরা হবে বলে জানিয়েছেন ডিপি ওয়ার্ল্ড গ্রুপ চেয়ারম্যান ও সিইও সুলতান আহমেদ বিন সুলায়েম। এছাড়া চট্টগ্রামের নিউমুরিন কনটেইনার টার্মিনালে বিনিয়োগেও তারা আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।
৫. বিশ্বের বৃহত্তম ফাস্ট ফ্যাশন গ্রুপ স্পেনের পোশাক জায়েন্ট ইন্ডিটেক্স, যার অধীনে বারশকাও মাসিমো দুত্তির মতো জনপ্রিয় ব্র্যান্ড রয়েছে তারা বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক আরও জোরদার করতে চান বলে জানিয়েছেন। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা অস্কার গার্সিয়া মাচেইরাস প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎকালে বাংলাদেশকে এন্ডিটেক্সের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সোর্সিং হাব হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
৬. চীনের খ্যাতনামা পোশাক উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান হান্ডা ইন্ডাস্ট্রিস লিমিটেড বাংলাদেশে ১৫ কোটি ডলার বিনিয়োগ করবে। তার মধ্যে ১০ কোটি ডলার অর্থনৈতিক অঞ্চলের আওতায় টেক্সটাইল ও ডাইং খাতে এবং পাঁচ কোটি ডলার রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে গার্মেন্টস শিল্পে বিনিয়োগ করা হবে। এ সংক্রান্ত একটি সমঝোতা স্মারক সইও হয়েছে।
৭. সম্মেলনে বিনিয়োগে অবদানের জন্য চার ক্যাটাগরিতে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে সম্মাননা পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। পুরস্কারপ্রাপ্তরা হলেন- ওয়ালটন, বিকাশ, স্কয়ার ফার্মাসিটিক্যালস ও ফেব্রিক্স। এছাড়া বিশেষ ক্যাটাগরিতে কোরিয়ান এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোনের চেয়ারম্যান কিহাক সাং-কে সম্মানসূচক নাগরিকত্ব দেওয়া হয়।
৮. বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ করতে দক্ষিণ কোরিয়ার বিনিয়োগকারীরা প্রস্তুত আছেন বলে জানিয়েছেন। গত 8 এপ্রিল দক্ষিণ কোরিয়ার ইয়াংওয়ান করপোরেশনের চেয়ারম্যান কিহাক সাংয়ের নেতৃত্বে কোরিয়ান বিনিয়োগকারীদের একটি প্রতিনিধিদল গত ৮ এপ্রিল প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকালে এ ঘোষণা দেন। এরপর গত ৭ এপ্রিল বিনিয়োগকারীরা চট্টগ্রামে কোরিয়ান এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন পরিদর্শন শেষে সেখানে শিল্পপার্কে অবিলম্বে বিনিয়োগের জন্য প্রতিশ্রুতি দেন।
টি আই / এনজি