সকাল ১১:৩৬ | মঙ্গলবার | ৮ই এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৫শে চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, বসন্তকাল | ৯ই শাওয়াল, ১৪৪৬ হিজরি

বাংলাদেশের গেমিং ইন্ডাস্ট্রি: বিলিয়ন ডলারের ভবিষ্যৎ

তথ্যপ্রযুক্তি ডেস্ক
১৯ মার্চ ২০২৫

 

সত্যি বলতে কী গেমিং নিয়ে ভাবলে বাংলাদেশের নাম প্রথমেই মাথায় আসে না। বরং পোশাকশিল্প ও কৃষিপ্রধান দেশ হিসেবে বাংলাদেশ পরিচিত। কিন্তু সময় যত বদলাচ্ছে এই দেশের মানুষও প্রযুক্তিপ্রেমী হচ্ছে। ১৭ কোটি মানুষের দেশ। তরুণদের একটা বড় অংশে প্রযুক্তিপ্রেমী রয়েছে, যেখানে গেমিং কোম্পানিগুলোর সম্ভাবনা অসীম।

মোবাইল গেমিং: এক নতুন সংস্কৃতি

এক সময় স্মার্টফোন ছিল বিলাসিতা। এখন বাংলাদেশের ৪০ শতাংশের বেশি মানুষের হাতে মোবাইল এবং এই সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। বাংলাদেশে ৮৫ শতাংশ পুরুষ এবং ৬৮ শতাংশ নারীর কাছে মোবাইল ফোন রয়েছে।

মজার বিষয় হলো, বাংলাদেশ পুরো কনসোল যুগটা এড়িয়ে সরাসরি মোবাইল গেমিংয়ে চলে এসেছে। যখন পাশ্চাত্য দেশগুলো প্লেস্টেশন ও এক্সবক্স নিয়ে বেড়ে উঠেছে, তখন বাংলাদেশ মোবাইল গেমিংকে আপন করে নিয়েছে, যা তৈরি করেছে সম্পূর্ণ আলাদা একটি গেমিং সংস্কৃতি।

সরকারের ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ উদ্যোগ ও বেসরকারি খাতের অবদানে ইন্টারনেটও আগের তুলনায় অনেক উন্নত হয়েছে। ফলে স্থানীয় স্টার্টআপ ও আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলো এখন বাংলাদেশের বাজারের দিকে নজর দিচ্ছে।

বাংলাদেশের জনপ্রিয় গেমিং ধারা

ছোট ছোট সেশনের গেমগুলোই জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। ঢাকা শহরের ট্রাফিকে আটকে থাকলে বা খাবারের বিরতিতে সহজে খেলা যায়— এমন গেমের চাহিদা বেশি। যেমন ‘ফ্রি ফায়ার’ বা ‘পাবজি’ অ্যাভিয়েটর গেমটি তরুণদের মধ্যে তুমুল জনপ্রিয় হয়েছে।

স্থানীয় প্রতিভা ও বৈশ্বিক স্বপ্ন

বাংলাদেশের গেম ডেভেলপারদের নিয়ে কমই আলোচনা হয়। কিন্তু সত্যি বলতে এখানে প্রচুর মেধাবী ডেভেলপার রয়েছেন। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখন গেম ডেভেলপমেন্ট শেখানো হচ্ছে। আর সেই তরুণরা নিজেদের গেমের মধ্যে বাংলাদেশি সংস্কৃতির ছোঁয়া দিয়ে ইউনিক কিছু তৈরি করছে।

মুনফ্রগ ল্যাবস ও টাইগার আইটি’র মতো স্টুডিও শুধু দেশে নয়, দক্ষিণ এশিয়ায়ও আলোচনায় এসেছে। তাদের সাফল্য নতুন প্রজন্মের ডেভেলপারদের অনুপ্রাণিত করছে।

তবে, চ্যালেঞ্জও কম নয়। উন্নতমানের টুলস, অভিজ্ঞ মেন্টর এবং সবচেয়ে বড় সমস্যা— অর্থায়নের অভাব। বিনিয়োগকারীরা ‘গেমিং স্টার্টআপ’ শুনলে অনেক সময় এটিকে ‘বাচ্চাদের খেলা’ ভাবেন। ফলে অনেক প্রতিভাবান ডেভেলপারদের নিজেদের টাকা খরচ করে গেম বানাতে হয় কিংবা বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে অংশীদারিত্ব করতে বাধ্য হয়— এতে তাদের সৃজনশীলতার ওপর নিয়ন্ত্রণ কমে যায়।

গেমিংয়ের অর্থনৈতিক প্রভাব

গেমিং কেবল বিনোদন নয়— এটি একটি বিশাল কর্মসংস্থানও তৈরি করতে পারে। গেমিং শিল্প বিকশিত হলে অ্যানিমেশন, মার্কেটিং, সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্টসহ বিভিন্ন খাতও সমানভাবে এগিয়ে যাবে।

বিদেশে গেম বিক্রি করে বাংলাদেশি ডেভেলপাররা বৈদেশিক মুদ্রা আনতে পারে। এটি দেশের অর্থনীতিকে বৈচিত্র্যময় করতে পারে, যেখানে এখনো প্রধানত গার্মেন্টস রপ্তানির ওপর নির্ভরশীল।

আর ব্রেইন ড্রেইন? বহু বছর ধরে বাংলাদেশের মেধাবীরা বিদেশে চলে যাচ্ছেন ভালো সুযোগের খোঁজে। গেমিং শিল্প যদি এগিয়ে যায়, তবে দেশের মধ্যেই তারা চ্যালেঞ্জিং ও উচ্চ বেতনের চাকরি পাবে, যার ফলে মেধা দেশেই থাকবে।

গেমিংয়ের মাধ্যমে সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তি

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, লোককথা, পুরাণ, ঐতিহ্য— এসব গল্প গেমের মাধ্যমে তুলে ধরা গেলে, শুধু তরুণদের বিনোদনই নয়, বরং তারা নিজেদের ঐতিহ্য সম্পর্কেও জানতে পারবে। একইসঙ্গে বিশ্বের মানুষও বাংলাদেশের সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে পারবে।

তবে বিষয়টা চ্যালেঞ্জিং। শুধু বাংলাদেশি গল্প বললেই হবে না, গেমটি আকর্ষণীয় হতে হবে। কিছু ডেভেলপার আধুনিক গেমপ্লের সঙ্গে ঐতিহ্যবাহী গল্প মিশিয়ে চমৎকার কিছু বানাচ্ছেন, যা দেখার মতো।

নীতিমালা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

বাংলাদেশে গেম কোম্পানি চালানো অনেক সময় ঝামেলাপূর্ণ। কপিরাইট আইন, গ্রাহক সুরক্ষা, কনটেন্ট রেটিং— এসব নিয়ে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা নেই। এর ফলে ব্যবসা চালানো কঠিন হয়ে পড়ে।

পেমেন্ট সমস্যাও বড় বাধা

বিকাশ, নগদের মতো মোবাইল পেমেন্ট থাকলেও আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে সমন্বয় করা কঠিন। ফ্রিমিয়াম মডেলের গেমগুলো থেকে কীভাবে আয় করা যায়, সেটাও দেশের বিদ্যমান কর কাঠামো বোঝে না। সরকার যদি এখানে একটু নমনীয়তা দেখায়, তবে শিল্পটি অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারে।

ইস্পোর্টস: এক নতুন বিপ্লব

পাবজি মোবাইল, মোবাইল লিজেন্ডসের মতো গেম নিয়ে বাংলাদেশে ইস্পোর্টসের উত্থান হয়েছে। হাজার হাজার তরুণ অংশ নিচ্ছে, দর্শকও বাড়ছে। গেমিং এখন সময় নষ্ট নয়, বরং ক্যারিয়ার গড়ার ক্ষেত্র হয়ে উঠছে।
গেমিং ক্যাফেগুলো কেবল খেলার জায়গা নয়— এটি এখন বন্ধুত্ব গড়ার কেন্দ্র। তবে, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিযোগিতা করতে গেলে ইন্টারনেট সমস্যা, প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা ও স্পন্সরশিপের অভাবের মতো বাধা দূর করতে হবে।

ভবিষ্যতের সম্ভাবনা

বাংলাদেশের শহরাঞ্চলে ইন্টারনেট সহজলভ্য হলেও গ্রামাঞ্চলে এখনো অনেক পিছিয়ে। এই বৈষম্য দূর করা গেলে, দেশের প্রতিটি কোণায় বিনোদন ও শিক্ষার সুযোগ পৌঁছানো সম্ভব।

নারীদের অংশগ্রহণ কম থাকাও বড় চ্যালেঞ্জ। গেমিং ইন্ডাস্ট্রিতে এখনো ছেলেদের আধিপত্যে রয়েছে— এটি বদলানো দরকার। নারী গেমার ও ডেভেলপারদের সম্পৃক্ত করা গেলে বাজার আরও বড় হবে, বৈচিত্র্যময় গেম তৈরি হবে।

শেষ কথা

বাংলাদেশ এখন গেমিং শিল্পের মোড়ে দাঁড়িয়ে। এটি ছোটখাটো একটি বাজার হয়ে থাকতে পারে, আবার ডিজিটাল অর্থনীতির চালিকাশক্তি হিসেবেও গড়ে উঠতে পারে। জনসংখ্যা, অবকাঠামো, প্রতিভা— সবকিছু তৈরি হচ্ছে।
সঠিক সিদ্ধান্ত নিলে আগামী ১০ বছরে বাংলাদেশ গেমিং বিশ্বে নিজের জায়গা করে নিতে পারে। শুধু গেমিং নয়, এটি কর্মসংস্থান, সংস্কৃতি সংরক্ষণ, ডিজিটাল দক্ষতা বৃদ্ধি এবং অর্থনীতির বৈচিত্র্য আনতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। গেমিং এখন শুধু বিনোদন নয় — এটি ভবিষ্যৎ!

 

 

শ ই / এনজি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *