নির্বাচন প্রশ্নে অতিদ্রুত সংলাপের উদ্যোগ নিতে আবারো অন্তর্বতীকালীন সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন মির্জা ফখরুল।
বুধবার দুপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব এই মন্তব্য করেন।
তিনি বলেন, ‘‘ আমরা এখনো এক-এগারোর কথা ভুলে যাননি। তাই আবার যখন ওই চেহারাগুলো সামনে আসে, তখন যথেষ্ট সন্দেহের উদ্রেক হয়, প্রশ্ন এসে যায়। সেজন্য আমরা একটা আলোচনার কথা বলেছি, পারস্পরিক আলোচনা দরকার।”
‘‘ আমরা কি চাই, উনারা(অন্তর্বতীকালীন সরকার) কি চান, জনগন কি চায়… একটা আলোচনা হতে হবে তো। সেই আলোচনার কথা বলেছি… সংলাপ করা প্রয়োজন…. বর্তমান সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর অতি দ্রুত আলোচনা প্রয়োজন। এটাই(সংলাপ) আমরা বলেছি, খুব জোর দিয়ে বলেছি। আজকে আবারো বললাম দ্রুত আলোচনা প্রয়োজন। না হলে হবে কি?অনেক ভুল-বুঝাবুঝি তৈরি হয়। সব কিছু তো পাবলিকলি হয় না।অনেক সময়ে আলোচনার মাধ্যমে অনেক কিছু বেরিয়ে আসে।”
১/১১ বিরাজনীতিকরণের লক্ষণ দেখছেন কিনা প্রশ্ন করা হলে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘‘ আমি লক্ষণ দেখছি না, সর্তক করছি। কিছু ফেইস দেখলে আমরা ভয় পাই। আপনারাও দেখেছেন। কোনো দিন দেখিনি… হঠাৎ করে মিডিয়ার ফ্রন্ট পেইজে চলে আসছে…তার বক্তব্য, তাদের থিওরি এগুলো আপনারা প্রচার করছেন।”
‘‘ এটা সুস্থ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার জন্য আমার কাছে মনে হয় যে, খুব একটা ভালো বিষয় না আরকি।খেয়াল করে দেখেছেন নিশ্চয় আপনারা আমার থেকে ভালো বুঝবেন। আমি কারো নাম বলতে চাই না, কিছুই বলতে চাই না। তাদের কখনই দেখলাম না, কোনো দিন সামনে আসতে দেখিনি, দেশের মানুষের সামনে আসলেন না হঠা করে দেখি তারা একেবারে ফ্রন্ট পেইজে চলে আসছে। তাদেরকে আমরা চিনি না।”
গতকাল রাতে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সভাপতিত্বে ভার্চুয়ালি জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠক হয়। এই বৈঠকের সিদ্ধান্তসমূহ জানাতে বুধবার দুপুরে গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এই সংবাদ সম্মেলন হয়।
‘১/১১‘র কথা ভুলি নাই’
সম্প্রতি জামায়াতে ইসলামীর আমীর শফিকুর রহমান দলীয় এক কর্মসূচিতে এই বন্যা পরিস্থিতির মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে বিএনপির দ্রুত নির্বাচনের দাবি এবং দখলদারির বিষয়ে কথা বলেন।এই বিষয়টি দৃষ্টি আকর্ষন করলে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘‘ আমরা তো এক-এগারোর কথা ভুলে যাইনি। এক-এগারোতে যেটা হয়েছিল বিরাজনীতিকীকরণের প্রচেষ্টা। যাদের জনসমর্থন নেই, জনগণ মনে করে না যে এরা সরকার চালাতে পারবে, তারা এ ধরনের বিভিন্ন চিন্তা–ভাবনা করে, আমি কোনো দলের নাম বলছি না।”
‘‘ সবচেয়ে বড় জিনিস হচ্ছে, আমাদের লড়াইটা গণতন্ত্রকে পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য। সেটার জন্যই তো নির্বাচন। এটা তো আমাদের রাইট,আমাদের অধিকার। আমরা তো নির্বাচনের জন্যই এত দিন লড়াই করেছি, সংগ্রাম করে এসেছি।
জামায়াতে ইসলামীকে ইঙ্গিত করে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘‘ তত্ত্বাবধায়ক সরকার যে বাতিল করা হলো, তার জন্য ওই দলগুলো মিলেই তো আমরা আন্দোলন করেছি। ওই দলগুলোর অনেকের আন্দোলনে অনেক নির্যাতন ভোগ করতে হয়েছে। এমনকি তাদের অফিস বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।”
‘‘ এখন ওই আন্দোলনকে ওই বিষয়কে বাদ দিয়ে আমি তো অন্য রাজনৈতিক চিন্তা এই মুহূর্তে করব না। হ্যাঁ, অন্তর্বর্তী সরকার এসেছে একটি আন্দোলন-বিপ্লবের মধ্য দিয়ে। অবশ্যই এই সরকারকে যৌক্তিক সময় দিতে হবে। তার জন্য সব ধরনের সহযোগিতা আমরা করে যাচ্ছি, করব যত দিন আমরা মনে করি সরকার রাইট ট্রাকে থাকবে… অবশই আমরা সেটা করব।”
তিনি বলেন, ‘আমরা তো ভুলে যাইনি এক-এগারোর সময় কারা চেষ্টা করেছিল বিরাজনীতিকীকরণের। এমনকি ওই সময়ে আমাদের দলকে পর্যন্ত পুরোপুরি বাতিল, নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টাও হয়েছিল। এ কথাগুলো তো আমরা ভুলতে পারি না। এটা আমার গণতন্ত্রের জন্য, আমার রাজনীতির জন্য, আমার দেশের কল্যাণের জন্য এ কথাগুলো আমার মনে রাখতে হবে।”
‘‘ আবার ওই চেহারাগুলোই যদি সামনে দেখি, তখন তো যথেষ্ট সন্দেহের উদ্রেক হয়,প্রশ্ন এসে যায়। সে কারণে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের দোসর হিসেবে যাঁরা কাজ করেছেন, যাঁরা সহায়তা করেছেন, যারা হত্যা করেছে, আমরা তাঁদের চেহারা যেভাবে দেখতে চান না। যাঁরা গণতন্ত্রকে ব্যাহত করার জন্য, ধ্বংস করার জন্য কাজ করেছেন তাঁদেরও এ দেশের মানুষ দেখতে চায় না।”
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘‘ মানুষ এখানে একটা ডেমোক্রেটিক সেটআপ চায়, গণতন্ত্র চায়। মানুষ নির্বাচন চায়। এই বিষয়গুলো মাথায় রাখতে হবে।”
‘‘ আপনি দেখবেন যে, মানুষ কত খুশি হয় যখন নির্বাচনের কথা উঠে। আমি যদি মনে করি, একজন ব্যক্তি একেবারে স্বর্গ বানিয়ে দিতে পারব—আমাদের ওই চিন্তাটা সঠিক হবে না। কারণ জনগণ সিদ্ধান্ত নেবে দেশ কীভাবে চলবে।”
তিনি বলেন, ‘‘ দেশের মানুষকে জিজ্ঞাসা করেন তারা বলবে হ্যাঁ নির্বাচন দরকার। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ব্যবসায়ীরা তারা মনে করছে যে, অতি দ্রুত একটা এ্যাকটিভ গভমেন্ট ইজ দেয়ার ব্যবসার জন্য, শিল্পের উন্নতির জন্য, অর্থনীতিকে সচল করার জন্য।দ্য সুন আফটার বেটার।”
‘‘ কারণ আমদানি করবে.. তা্রা বলে যে, ঠিকমতো যে রপ্তানি করবে তারা বলছে যে, তোমাদের ইলেক্টেড গভমেন্ট না থাকলে তো আমরা ব্যবসা করব না। ইট ইজ ফ্যাক্টস। আপনারা বড় ব্যবসায়ীদের, ব্যবসায়ী লিডারদের সাথে কথা বলেন এটাই বলবেন।”
সংস্কার প্রশ্নে ফখরুল বলেন, ‘‘ সংস্কারের দাবি তো আমরাই তুলেছি। আমরা ৩১ দফা দিয়েছি। ৩১ দফা থেকে কমিয়ে ১০ দফা হয়েছে, ১০ দফা থেকে এক দফা হয়েছে। এটা নিয়ে আমরা আন্দোলন করেছি সারা বাংলাদেশ চষে বেড়িয়েছি। আমরা তো সংস্কার চাই। তবে সেই সংস্কারটা অবশ্যই হতে হবে জনগণের সমর্থন নিয়ে।”
‘রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধের বিপক্ষে বিএনপি’
জামায়াতে ইসলামী নিষিদ্ধের প্রজ্ঞাপন বাতিলের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষন করা হলে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘‘ আমরা কোনো রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধের পক্ষে না… সে যে দলই হোক। আমার সংবিধানে যেকোনো ব্যক্তির যে অধিকার রয়েছে সংগঠন করবার সেটা থাকতে হবে। কিন্তু দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বে পক্ষে থাকতে হবে দ্যাট ইজ ভেরি ট্রুথ।”
‘‘ আমার বাংলাদেশের স্বাধীনতায় যে বিশ্বাস করে না, সেই ধরনের দলকে তো সমর্থন করা যাবে না। কিন্তু আমরা মনে করি, মানুষের অধিকার আছে সংগঠন তৈরি করবার, এটা তার সাংবিধানিক অধিকার আছে রাজনীতি করবার সেটা যে কেউ করতেই পারে। এটা নিয়ে আমাদের বিরুপ কিছু নেই।”
‘দখলদারিতে বিএনপি নেই’
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘‘ আমরা লক্ষ্য করছি, বিভিন্ন জায়গায় কিছু কিছু দুর্বত্ত দখলবাজী করে তা বিএনপির ওপরে চাপানোর চেষ্টা করছে।আমরা স্পষ্টভাষায় বলে দিতে চাই, যে কোনো রকম দুর্বত্তায়নের সঙ্গে বিএনপি বা তার অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা জড়িত নন… এটা আমরা জোর দিয়ে বলছি।”
‘‘ এটা আমার খুব অবাক লেগেছে নামকরা পত্রিকাড়গুলো তারাও আপনার বিএনপিকে জড়িয়ে নিউজ করছেন। এটা বোধ করি সম্ভব হয়েছে যে, একজন দুই জন ব্যক্তিবর্গ যদি অপকর্ম করে সেটা তো বিএনপির দ্বারা হয় না। আমরা যখনই শুনছি তখনই ব্যবস্থা নিচ্ছি। প্রায় ৫৬/৫৭ জন নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি।”
‘ঢালাও মামলা দেয়া ঠিক নয়’
মির্জা ফখরুল বলেন,‘‘ এখন ঢালাও মামলা দেয়া হচ্ছে। যে কোনো মানুষের বিরুদ্ধে শত্রুতা থাকলে মামলা দেয়া হচ্ছে। মামলা নেয়ার আগে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রাথমিকভাবে যাচাই করে নেয়া দরকার… এটা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি আমার অনুরোধ থাকবে।”
‘‘ ঢালাও মামলায় বিরুপ ঘটনা ঘটছে। আমি মনে করি, এটা একেবারেই বন্ধ হওয়া দরকার। এখন যেভাবে মামলা হচ্ছে সেটা এই বিপ্লবকে সংহত করবে না। আমি আমার দলের নেতা-কর্মীদের বলব, তারা এমন কোনো মামলা দেবেন না যে মামলায় কোনো সারবস্তু থাকবে না। এমন এমন অভিযোগ আসছে জেলা প্রশাসকের বিরুদ্ধে মামলা দিচ্ছে। এটা ঠিক না… একটা প্রশাসন আছে, অন্তর্বতীকালীন সরকার আছে … একটা ক্রান্তিকাল পার হচ্ছি আমরা। সেজন্য যতদূর সম্ভব প্রশাসনের সাথে সহযোগিতা করে একটি স্থিতিশীল অবস্থা নিয়ে আসা।”
‘সংখ্যালুঘু প্রসঙ্গে’
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘‘আপনারা দেখবেন, বিদেশ থেকে, বিশেষ করে ভারত থেকে এমন কতগুলো প্রচারণা চালানো হচ্ছে, যা বাংলাদেশে যে বিপ্লব সেটাকে তারা নস্যাৎ করতে চায়। কতগুলো রাজনৈতিক ইস্যুকে তারা সাম্প্রদায়িক ইস্যু বানাতে চায়। যেটা একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়।”
‘‘ দেশের স্বার্থে জনগনের স্বার্থে আপনাদের(গণমাধ্যম) এগুলো প্রচার করা দরকার।”
তিনি বলেন, ‘‘ বিএনপি লক্ষ্য করে এসব করা হচ্ছে। এটা সম্পূর্ণ অন্যায়। বিএনপি গত ১৫ বছর ধরে এদেশের গণতন্ত্র পূনরুদ্ধারের জন্য সবচেয়ে বেশি ত্যাগ স্বীকার করেছে, করছে। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে ৬ বছর কারাগারে থাকতে হয়েছে মিথ্যা মামলায়…।”
‘‘ বিএনপির অবদানকে খাটো করার একটা পরিকল্পিত ক্যাম্পেইন আছে। আমরা দীর্ঘকাল সংগ্রাম করেছে, আমরা ১৫ বছর ধরে সংগ্রাম করেছি গণতন্ত্রের জন্য, ভোটের অধিকারের জন্য। মনে রাখত হবে, গণতন্ত্রে নির্বাচিত সংসদ ছাড়া কোনো সমস্যার সমাধান হয় না।”
‘প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অর্থ ত্রাণ তহবিলে’
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘‘ বন্যার কারণে আমাদের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ১ সেপ্টেম্বর থেকে যে ছয়দিনের বড় কর্মসূচি নেয়া হয়েছিলো স্থায়ী কমিটির সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে যে, প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মসূচি একেবারে কমিয়ে আনার। সেখানে যে অর্থ ব্যয় হওয়ার কথা ছিলো সেই অর্থ আমরা আমাদের দলের ত্রাণ তহবিলে দিয়ে দেবো । সেখান থেকে তা দূর্গত মানুষের কাছে যাবে।”
‘‘ এখন প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর যে কর্মসূচি থাকবে সেটা হলো ১ সেপ্টেম্বর সকালে সারাদেশের দলীয় কার্যালয় গুলোতে দলীয় পতাকা উত্তোলন, সকাল ১১টায় দলের প্রতিষ্ঠাতা স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মাজারে শ্রদ্ধা জানানো হবে। বাদ আসর সারাদেশে ভানবাসী দূর্গত মানুষ এবং সাম্প্রতিক আন্দোলনে নিহতদের জন্য দোয়া মাহফিল হবে এবং একই সঙ্গে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার রোগমুক্তি, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সাহেব যাতে দেশে ফিরে আসতে পারেন সেজন্য আমরা দোয়া চাইব।”
দেশের পূর্বাঞ্চলে জেলাসমূহে বন্যায় দূর্গত মানুষের পাশে বিএনপি ত্রাণ সামগ্রি নিয়ে কাজ করছে বলে জানান বিএনপি মহাসচিব।
সংবাদ সম্মেলনে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান উপস্থিত ছিলেন।
জা ই / এনজি