ডিএমপি কমিশনার : হর্ন বাজালেই মামলা, বন্ধ হচ্ছে ‘মোটরসাইকেল ফ্যামিলি রাইড’

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
২১ ডিসেম্বর ২০২৪

 

রাজধানী ঢাকায় গাড়িচালকরা অনবরত হর্ন বাজাতেই থাকেন উল্লেখ করে ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী বলেছেন, অনবরত হর্ন বাজানো চালকদের বিরুদ্ধে স্পটেই ট্রাফিক সার্জেন্টরা মামলা করতে পারবেন।

এছাড়া মোটরসাইকেলে স্ত্রীসহ তিন-চারটি বাচ্চা নিয়ে ফ্যামিলি রাইড বন্ধ করার কথাও জানিয়েছেন তিনি। ডিএমপি কমিশনার বলেন, মোটরসাইকেলে ফ্যামিলি রাইড নয়। এটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ বাহন।

শনিবার (২১ ডিসেম্বর) রাজধানীর কাকরাইলে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে পুলিশ, ছাত্র, জনতা ও রমনা মডেল থানা এলাকার নাগরিকদের মতবিনিময় সভায় তিনি এসব কথা বলেন।

ডিএমপি কমিশনার বলেন, মোটরসাইকেলের সামনে তিন বছরের বাচ্চা, সঙ্গে আরও দুই বাচ্চা, পেছনে চালকের স্ত্রী এবং তার কোলেও বাচ্চা। মোটরসাইকেল ফ্যামিলি রাইডের জন্য নয়। আপনারা স্ত্রী-সন্তানকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে এভাবে মোটরসাইকেল রাইড করেন, যা খুবই দুঃখজনক। ট্রাফিক (পুলিশ) দিয়ে এ ব্যাপারে খুব কড়াকড়ি করা হচ্ছে। ফ্যামিলি রাইড হিসেবে মোটরসাইকেল ব্যবহার করা যাবে না।

অনবরত হর্ন বাজানোর কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, সব ধরনের গাড়িচালকরা সমানে হর্ন বাজাতে থাকেন। হর্ন দিয়ে কান ফাটিয়ে ফেলেন। স্কুল-কলেজ এমনকি হাসপাতালের সামনে সমানে হর্ন দেওয়া হয়। এই হর্ন বাজানোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কোনো আইন নেই। তবে ব্যবস্থা আমি নেবো। এরই মধ্যে সরকারের সঙ্গে আলোচনা করেছি ও চিঠি দিয়েছি। পরিবেশ ও সড়ক আইনে পরিবর্তন এনে হর্ন বাজানো চালকদের বিরুদ্ধে স্পটেই ট্রাফিক সার্জেন্টরা মামলা দেবেন।

যানজট এড়াতে যাদের বাসা থেকে অফিসের দূরত্ব অনেক বেশি তাদের অফিসের কাছাকাছি বাসা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন ডিএমপি কমিশনার। তিনি বলেন, অফিসের কাছে বাসা হলে গাড়ি ব্যবহার করা লাগবে না, যানজটেও পড়তে হবে না। পায়ে হেঁটে বাসা থেকে অফিসে যেতে পারবেন। ফলে গাড়ি ও অটোরিকশা কমে আসবে এবং যানজট কমে আসবে।

তিনি জানান, একটি শহরের রাস্তা যেখানে ২৫ শতাংশ থাকার কথা কিন্তু ঢাকা শহরে রাস্তা আছে মাত্র ৭ শতাংশ। তাই নানান সমস্যা এই শহরে সৃষ্টি হচ্ছে।

মাদকের ভয়াবহতার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, মাদক সেবকদের টাকার দরকার হলে তারা ছিনতাই করে। মাদক নির্মূল, ডিলারদের ধরা সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে করতে হবে। সব দায়িত্ব পুলিশের ঘাড়ে ছেড়ে দিলে এত দায়িত্ব পুলিশের একার পক্ষে নেওয়া অত্যন্ত কঠিন।

থানায় মামলা ও সাধারণ ডায়েরির বিষয়ে ঢাকার পুলিশ কমিশনার বলেন, থানায় অফিসারদের বলেছি যত খুশি মামলা হয় হোক, সেই দায়িত্ব আমি নেবো। কিন্তু কোনো নাগরিক থানায় গিয়ে যেন না বলে পুলিশ মামলা নেয়নি। যে অপরাধ হবে সেই অপরাধে মামলা হবে। এর ব্যত্যয় আমি মেনে নেবো না। আমার মেসেজ একটাই, একটি থানায় ৫০০ মামলা হোক কোনো সমস্যা নেই; কিন্তু মানুষ অপরাধের স্বীকার হলে মামলা করতে হবে। কোনো মামলা হাইড (লুকানো) যাবে না। সব ঘটনা মামলায় লিপিবদ্ধ করতে হবে।

পুলিশের ৮০ শতাংশ মনোবল ফিরে এসেছে। বাকি ২০ শতাংশ মনোবলও শিগগির ফিরে আসবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন পুলিশের এ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।

গত এক মাসে নানান আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে জানিয়ে শেখ সাজ্জাত আলী বলেন, সর্বশেষ তাবলিগ জামাত নিয়েও আমাদের বড় ধরনের সমস্যা মোকাবিলা করতে হয়েছে। তাবলিগ জামাতের মধ্যে মতপার্থক্য থাকতে পারে, কিন্তু মতপার্থক্য সমাধানের জন্য মারামারি বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি উচিত নয়। তিনজন মানুষের প্রাণ গেলো। আমরা তো আলোচনার টেবিলে বসে অনেক চেষ্টা করলাম, কিন্তু সমাধান না হওয়ার কারণে তিনটি প্রাণ চলে গেলো। এই দায়িত্ব কে নেবে? ইসলামে এ ধরনের (সংঘাতের) সুযোগ আছে বলে আমরা মনে করি না।

‘আপনাদের (তাবলিগ জামাত) সমস্যা থাকলে টেবিলে বসে সমাধান করেন। যত্রতত্র মিছিল, রাস্তা আটকিয়ে দেওয়া; এর ফলে সড়কে ব্যাপক যানজট। ঢাকাবাসীর ব্যাপক দুর্ভোগ ও কষ্ট হয় যানজটের কারণে। মুমূর্ষু রোগী হাসপাতালে যেতে পারে না, বিদেশগামী যাত্রী বিমানবন্দরে যেতে পারে না, স্কুলে সময় মতো বাচ্চারা পৌঁছাতে পারে না। তাদের কথা যদি আমরা না ভাবি তাহলে (ঢাকায় বসবাসরত) দুই-আড়াই কোটি মানুষের জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য দেবেন কীভাবে! তাই কোনো একটি অনুষ্ঠান, মিছিল করতে গিয়ে যেন অন্যের দুর্ভোগ টেনে না আনি।’

চাঁদাবাজি প্রসঙ্গে ডিএমপি কমিশনার বলেন, চাঁদাবাজি একটি সামাজিক অপরাধ। চাঁদাবাজি মোকাবিলার জন্য শুধু পুলিশ নয়, সমাজের সবার এগিয়ে আসতে হবে, সবাইকে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। চাঁদাবাজির কারণে নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি পাচ্ছে। সমাজের অধিকাংশ লোক নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির। নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি পাওয়ায় তাদের সংসার চালাতে ও আর্থিক কষ্ট হয়।

চাঁদাবাজি ঠেকানোর জন্য আমার ও আমার সহকর্মীদের ওপর অনেক দায়িত্ব। চাঁদাবাজদের একটি হালনাগাদ লিস্ট (তালিকা) করছি। এই তালিকা এক-দুদিনের মধ্যে সম্পন্ন হলে চাঁদাবাজদের গ্রেফতার ও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য অচিরেই পদক্ষেপ নেওয়া হবে, যোগ করেন তিনি।

চাঁদাবাজদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, আমাকে কঠোর হতে বাধ্য করবেন না।

ছিনতাই প্রসঙ্গে ডিএমপি কমিশনার বলেন, আমার কাছে যে রিপোর্ট তাতে ঢাকায় ছিনতাই অনেক বেড়ে গেছে। ছিনতাইয়ের মধ্যে অধিকাংশ মোবাইল ফোন ছিনতাই হচ্ছে। বাসে যাত্রী বসে থাকে পাশ থেকে মোবাইল ছিনিয়ে দৌড় দেয়। এছাড়া যাত্রীদের ছুরির ভয় দেখিয়ে মোবাইল টান দিয়ে নিয়ে যায়। মোবাইল ফোন ছিনতাই অনেক হচ্ছে।

অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে পড়তে আসা বিদেশি শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে ঢাকার পুলিশ কমিশনার বলেন, ঢাকায় মোবাইল ফোন ছিনতাই বেড়েছে। এজন্য তোমাদের মোবাইল ফোনগুলো সাবধানে রাখবে যখন বাইরে বের হবে।

মিটিং-মিছিল অবশ্যই রাজনৈতিক দলের অধিকার জানিয়ে ডিএমপি কমিশনার বলেন, যত্রতত্র মিটিং-মিছিল, সভা-সমাবেশ হয় তাহলে ট্রাফিক খুব সমস্যা হয়। কোনো রাস্তা যদি এক ঘণ্টা বন্ধ থাকলে এর রেশ কাটতে সাত-আট ঘণ্টা সময় লেগে যায়। এজন্য রাজনৈতিক ও ধর্মীয় দলের মিটিং-মিছিল ও সভা-সমাবেশ রাস্তার পরিবর্তে বদ্ধ জায়গায় করলে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় সুবিধা হয়।

তিনি আরও বলেন, ইদানিং বাড়িঘর করতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে কনস্ট্রাকশনের জিনিসপত্র রাস্তায় রেখে চলাচলের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে ডিএমপির আইনে মামলা করার ব্যবস্থা আছে, তবে আমি সে ধরনের কাজে যেতে চাই না। অনুরোধ করবো রাস্তায় ইট-বালু রাখবেন না, সতর্ক থাকবেন।

মতবিনিময় সভায় উপস্থিত ছাত্র-জনতা ও রমনা থানা এলাকার নাগরিকরা ডিএমপি কমিশনারের কাছে তাদের বিভিন্ন মতামত ও পরামর্শ তুলে ধরেন। ডিএমপি কমিশনার উপস্থিত সবার কথা মনোযোগ সহকারে শুনেন এবং ডিএমপির পক্ষ থেকে সর্বাত্মক সহযোগিতার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।

রমনা থানা এলাকার নাগরিক একরামুল বলেন, পুলিশ-জনতা ভাই ভাই। ৫ আগস্টের পর পুলিশের কাজ প্রশংসনীয়। এ কারণে মানবাধিকার পরিস্থিতি ধীরে ধীরে উন্নত হচ্ছে।

সভায় উপস্থিত ফৌজিয়া ইসলাম নওশীন বলেন, আপনারা ছাত্রদের ডেকেছেন, আমাদের কথা বলার সুযোগ দিচ্ছেন- এজন্য আপনাদের আন্তরিক ধন্যবাদ। এ উদ্যোগের ফলে আমাদের এলাকার সমস্যাগুলো চিহ্নিত হবে এবং সমাধানের পথ বের হবে।

পবিত্র কোরআন থেকে তিলাওয়াতের মাধ্যমে মতবিনিময় সভা শুরু হয়। এরপর গত জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে শহীদদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। পরে সব শহীদের আত্মার মাগফিরাত কামনা ও আহতদের দ্রুত সুস্থতার জন্য মোনাজাত করা হয়।

মতবিনিময় সভায় স্বাগত বক্তব্য রাখেন রমনা বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মো. মাসুদ আলম। সভায় অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) মো. ইসরাইল হাওলাদার, অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (লজিস্টিকস, ফিন্যান্স অ্যান্ড প্রকিউরমেন্ট) হাসান মো. শওকত আলী, অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (সিটিটিসি) মো. মাসুদ করিমসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, পেশাজীবী, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের নেতৃবৃন্দ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান এবং ছাত্র আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।

 

টি আই / এনজি

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *