দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে বড় বিনিয়োগের আগ্রহ দেখাচ্ছে চীন। এ নিয়ে চিঠি চালাচালিও কম হয়নি। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট স্থাপনের বাইরে অন্য বিষয়ে আগ্রহ দেখায়নি বিগত আওয়ামী লীগ সরকার। তবে বিষয়টি নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে জোরেশোরে কাজ করছে চীন।
চীনের অর্থায়নে দেশে হাসপাতাল হবে, এমন খবরে দেশব্যাপী দাবির জোয়ার বইছে। কাঙ্ক্ষিত হাসপাতালটি নিজ এলাকায় করতে অনলাইন-অফলাইনে দাবি তুলছেন। নিজ নিজ জেলায় এই হাসপাতাল স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে মানববন্ধন বা ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। সাধারণ জনগণের বাইরে নেতাদের বেশি সক্রিয় দেখা গেছে এ কাজে। অথচ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ‘প্রাথমিক আলাপ হয়েছে মাত্র। এটি দাবি করার পর্যায়ে যায়নি।’
সূত্র জানায়, এরই মধ্যে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রংপুর বিভাগে হাসপাতাল করার বিষয়ে কাজ চলমান। বিশেষ করে নীলফামারী, ফেনী ও ঢাকায় হাসপাতাল তিনটি হবে- এমন সিদ্ধান্ত ঘিরেই কাজ চলছে। নীলফামারীতে এক হাজার শয্যার হাসপাতাল করার বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ও বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক আলাদা অনুষ্ঠানে বলেছেন।
এ নিয়ে দেশের বিভিন্ন জেলায় মানববন্ধনও হয়েছে। সবাই চায় নিজ জেলায় হোক। এনসিপি নেতা সার্জিস আলম পঞ্চগড়ে এটি করার জন্য প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেছেন।
ওগুলো নিয়ে প্রাথমিক আলোচনা হয়েছে। ফাইনাল কোনো আলাপ হয়নি।-স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. আবু জাফর
গত ১৩ এপ্রিল রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নুরজাহান বেগম বলেন, বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে বড় ধরনের বিনিয়োগের পরিকল্পনা নিয়েছে চীন। পর্যায়ক্রমে তিনটি অত্যাধুনিক হাসপাতাল তৈরি করবে চীনা বিনিয়োগকারীরা।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ ও চীনের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে চীন একটি এক হাজার শয্যার হাসপাতাল উপহার হিসেবে দিচ্ছে। হাসপাতালটি উত্তরবঙ্গ, বিশেষ করে রংপুর, দিনাজপুর ও নীলফমারীতে নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশে রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার উইথ রোবোটিক ফিজিওথেরাপি সাপোর্ট সেন্টারের যন্ত্রপাতি চীন থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে এসে পৌঁছেছে। শাহবাগের বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (আগের বিএসএমএমইউ) তৈরি হচ্ছে এই সেন্টার।
একই সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক জানান, সাভারের ধামরাইয়ে রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার ও চট্টগ্রামের কর্ণফুলীতে ৫০০ বেডের হাসপাতাল তৈরি করতে চায় চীন। এই দুটি হাসপাতালের জন্য জমি খোঁজাও চলমান।
হাসপাতাল তৈরি প্রসঙ্গে স্বাস্থ্যের মহাপরিচালক বলেন, তিস্তা প্রকল্পের আশপাশে ন্যূনতম ১২ একর জায়গা খোঁজা হচ্ছে। নীলফামারী, রংপুর ও দিনাজপুরের মাঝামাঝি জায়গায়। তবে নীলফামারীতে একটি জায়গা পেয়েছি। এটার সম্ভাবনা যাচাইয়ের একটা সমীক্ষা আমরা করবো।
আলোচনা ২০২০ সাল থেকেই
করোনা মহামারির শুরুতে চীনের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান চীনা মেশিনারি ইঞ্জিনায়ারিং করপোরেশন (সিএমইসি) দেশের বিভাগীয় আট শহরে এবং প্রতিটি জেলা শহরে যৌথ উদ্যোগে হাসপাতাল গড়ে তোলার প্রস্তাব দেয়। ২০২০ সালে এ প্রস্তাব তারা প্রথম দেয় বেইজিংয়ে বাংলাদেশ দূতাবাসের বাণিজ্যিক শাখায়। প্রস্তাবে বলা হয়, চিকিৎসাসেবার স্বল্পতার কারণে বাংলাদেশের মানুষ উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে যায়, সঙ্গে প্রতি বছর ৪০০–৫০০ কোটি মার্কিন ডলার বিদেশে চলে যায়। এমন পরিস্থিতি মানসম্পন্ন সেবা ও বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগের একটি সুযোগ।
এতে বলা হয়, এসব হাসপাতালের মান হবে সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ বা ব্যাংককের বামরুনগ্রাদ হাসপাতাল বা বাংলাদেশের স্কয়ার ও ইউনাইটেড হাসপাতালের সমতুল্য। তবে যৌথ উদ্যোগে তৈরি হাসপাতালে রোগ নির্ণয়, পরীক্ষার ফি হবে ওই হাসপাতালগুলোর ফির চেয়ে কম। এসব হাসপাতালে দেশি চিকিৎসক ও নার্স থাকবেন ৭০ শতাংশ। বাকিদের বিদেশ থেকে আনা হবে। কিডনি, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ ও ক্যানসারের মতো রোগের চিকিৎসা হবে। হাসপাতালের জমির বন্দোবস্ত করতে হবে বাংলাদেশ সরকারকে।
স্বাস্থ্যখাতে সহযোগিতার বিষয়ে চীন আগ্রহ প্রকাশ করেছে এবং নীতিগতভাবে একমত হয়েছে- এটুকুই। এর বাইরে বিস্তারিত আলোচনা হয়নি। মানববন্ধন করে দাবি জানানোর মতোও নয়।- উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. সায়েদুর রহমান
সাবেক প্রধানমন্ত্রীর তৎকালীন মুখ্য সচিব আহমদ কায়কাউসকেও স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগের বিষয়ে চিঠি দেয় চীন। ২০২০ সালের ২১ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিবকে একটি চিঠি পাঠানো হয়। ওই চিঠিতে চীনা প্রতিষ্ঠানের প্রস্তাবিত বিনিয়োগের বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়। ওই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে। কমিটির অন্যতম কাজ ছিল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সঙ্গে সমন্বয় রেখে হাসপাতাল তৈরির সম্ভাব্যতা যাচাই করা। ওই সময় দেশের একটি শীর্ষস্থানীয় আবাসন প্রতিষ্ঠান ৬৪টি জেলায় হাসপাতাল নির্মাণের জন্য জমির ব্যবস্থা করে দেওয়ার আগ্রহ দেখিয়ে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিবকে চিঠি দেয়। তবে মহামারির কারণে ৬৪ জেলায় হাসপাতাল গড়ে তোলার যৌথ উদ্যোগটি কিছুটা নিষ্ক্রিয় অবস্থায় ছিল।
সে সময় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব জাহাঙ্গীর গণমাধ্যমকে বলেন, আমরা আগে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের কাজটি ঠিকভাবে শেষ করার কথা ভাবছি। অন্য কিছু আপাতত আমাদের চিন্তার মধ্যে নেই।
হাসপাতাল স্থাপনে জেলায় জেলায় দাবি
চীনের আগ্রহের খবরে হাসপাতাল নির্মাণের দাবিতে রংপুর, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী, গাইবান্ধা, দিনাজপুর, যশোর, খুলনা, চট্টগ্রাম, ফেনী, লক্ষ্মীপুর ও বরিশালের বিভিন্ন জেলাসহ দেশের নানান প্রান্তে মানববন্ধন কর্মসূচি হয়েছে। এসব কর্মসূচিতে একই ব্যানারে বিএনপি, জামায়াত, এনসিপি ও অন্য দলের নেতাকর্মীদের অংশ নিতে দেখা যায়।
পিছিয়ে পড়া দক্ষিণাঞ্চলে ‘বৈষম্য নিরসন ও জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন এবং জনভোগান্তি নিরসনে’ পাঁচ দফা দাবি বাস্তবায়নে গত শনিবার মানববন্ধন করে বৈষম্যবিরোধী দক্ষিণাঞ্চল কমিউনিটি, বৃহত্তর বরিশাল। কর্মসূচিতে বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালের তিনটির একটি বরিশালে স্থাপন করাসহ পাঁচ দফা দাবি জানানো হবে। পর্যায়ক্রমে দেশের অন্য জেলায়ও চীনা সহায়তায় হাসপাতাল নির্মাণের দাবিতে কর্মসূচির পরিকল্পনা চলছে। সামাজিক মাধ্যমেও নিজ নিজ জেলায় হাসপাতালের দাবিতে পোস্ট দিয়ে দাবি জানান বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ।
একই ইস্যুতে গত ১৬ এপ্রিল পঞ্চগড়ে অনুষ্ঠিত সমাবেশে বক্তারা বলেন, আমাদের পার্শ্ববর্তী জেলা দিনাজপুর, রংপুর ও নীলফামারীতে মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল হয়েছে। চীনের অর্থায়নে প্রস্তাবিত এক হাজার শয্যার মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল পঞ্চগড়ে করতে হবে। এটা হলে ভুটান, নেপাল ও চীনের ছাত্রছাত্রীরা এখানে পড়াশোনা এবং চিকিৎসাসেবা নিতে আসবে। আমরাও বিশ্বমানের চিকিৎসাসেবা পাবো।
পঞ্চগড়ে হাসপাতাল করার জন্য এনসিপি নেতা সারজিস আলম প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। আবার ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সাইফ মাহমুদ জুয়েল নামে একজন ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ‘চিকিৎসাসেবায় বরিশালবাসী সর্বাধিক বঞ্চিত। চায়না ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালের সর্বোচ্চ দাবিদার বরিশাল।’
আলোচনা প্রাথমিক পর্যায়ে
হাসপাতাল স্থাপন নিয়ে এত হইচইয়ের মধ্যেও জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. আবু জাফর বলেন, ‘ওগুলো নিয়ে প্রাথমিক আলোচনা হয়েছে। ফাইনাল কোনো আলাপ হয়নি।’
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. সায়েদুর রহমানও বলেন, ‘স্বাস্থ্যখাতে সহযোগিতার বিষয়ে চীন আগ্রহ প্রকাশ করেছে এবং নীতিগতভাবে একমত হয়েছে- এটুকুই। এর বাইরে বিস্তারিত আলোচনা হয়নি। মানববন্ধন করে দাবি জানানোর মতোও নয়। চীন কীভাবে স্বাস্থ্যখাতে সহায়তা করবে এ নিয়ে মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা হয়নি। এর আকার কী হবে, কী ধরনের হবে- এগুলো একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে।’
শ ই / এনজি