নিজস্ব প্রতিবেদক
২৪ জুলাই ২০২৪
চলমান সংকটের রাজনৈতিক সমাধান না হলে আন্দোলন শেষ হবে না’ বলে মন্তব্য করেছেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
বুধবার (২৪ জুলাই) বিকালে গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে ‘নানা ঘটনা প্রবাহের পর চলমান আন্দোলন সমাপ্তি হয়েছে কিনা জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব এই মন্তব্য করেন।
তিনি বলেন, ‘‘ না এটা(আন্দোলন শেষ হওয়া) কখনো হয়নি, অতীতেও হয়নি। আপনি যদি অতীতের ইতিহাস দেখেন, পাকিস্তান আমলের ইতিহাস দেখেন সেখানেও দেখবেন বহুবার আন্দোলন এসেছে, আন্দোলন এক পর্যায়ে হয়ত সেটা স্তিমিত হয়েছে তারপরে কিন্তু আন্দোলন আরও বেগবান হয়েছে। এবারকার আন্দোলন তো একটা ‘আইওপেনার’। এবারকার আন্দোলনে সমস্ত মানুষ… সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছে। আপনারা নিজেরাও অনেক রিপোর্ট করেছেন। এক বাচ্চা ছেলে ১৫/১৬ বছরের বয়স সে তার মায়ের কাছে বলে চলে এসেছে যে, আমি যাবো, সাধারণ মানুষ বেরিয়ে এসেছে যে, না ওদের সঙ্গে আমাদের যেতে হবে।”
‘‘কারণ আমার রুটি-রুজির ব্যাপার আছে… জিনিস পত্রের দাম যেভাবে বেড়েছে আমরা কুলিয়ে উঠতে পারছি না… সরকার সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। আজকে একদিকে কোটা আন্দোলন শিক্ষার্থীদের ছিলো, অন্যদিকে সরকারের চরম ব্যর্থতা সর্বক্ষেত্রে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে, দূর্নীতি দমনের ক্ষেত্রে… দূর্নীতি তারা নিজেরাই করে সব খানে তারা এতো ব্যর্থ হয়েছে যে, রাষ্ট্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ। সেই কারণেই জনগনের পুঞ্জিভূত যে ক্ষোভ তারই বর্হিপ্রকাশ হয়েছে এই আন্দোলনের মধ্য দিয়েছে। হ্যাঁ সাময়িকভাবে সেনা বাহিনী নামিয়ে, দমনপীড়ন করে, নির্যাতন-নিপীড়ন করে, তারা এটাকে হয়ত থামিয়ে দিতে পারে। এটার যদি রাজনৈতিক সমধান না করে তাহলে কিন্তু কখনো এটার শেষ সমাধান হবে না।”
রাজনৈতিক সমাধানটা কি প্রশ্ন করা হলে মির্জা ফখরুল স্পষ্টভাষায় বলেন, ‘‘ রাজনৈতিক সমাধান হচ্ছে সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে এবং নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে একটা নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে।”
গত কয়েকদিন যাবত বিএনপি মহাসচিব বিবৃতির মাধ্যমে দলের বক্তব্য উপস্থাপন করলেও বুধবার কারফিউ ৭ ঘন্টা শিথিল থাকার মধ্যে গণমাধমের মুখোমুখি হন বিএনপি মহাসচিব।
‘তারেকের ভাবমূর্তি ক্ষুন্নের অপচেষ্টা’
বক্তব্যের শুরুতে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘‘ গত কয়েকদিন ধরে কারফিউ দেয়ার পর থেকে সরকার অত্যন্ত সচেতন ভাবে একটা জিনিস প্রমাণ করতে চাইছে যে, আন্দোলন, বিভিন্ন হত্যার ঘটনা, ভাংচুর হয়েছে সব কিছুর জন্য দায়ী হচ্ছে তারেক রহমান সাহেব। এটা প্রত্যেকটি কথার মধ্যে এটা আসছে। এথেকে বুঝা যায় যে, তারা তারেক রহমান সাহেবকে হেয় প্রতিপন্ন করা, তার ভাবমূর্তি বিনষ্ট করা এবং জনগনের দৃষ্টিকে ভিন্ন দিকে নিয়ে যাওয়া এবং একই সঙ্গে বিএনপিকে দায়ী করা, বিরোধী দলকে দায়ী করা। সরকারের এসব বক্তব্য অমূলক, বিভ্রান্তিকর, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত।”
‘‘ এখান থেকে একটা জিনিস প্রমাণিত হয় যে, তারা জনগনের সমস্যা নিয়ে কথা বলছে না। তারা যখনই কথা বলছে তারা কিন্তু কয়েকটি সরকারি স্থাপনায় আক্রমন হয়েছে সেই কথাগুলোই বলছে। এই আন্দোলনের শত শত প্রাণ কেড়ে নিলো সেই ব্যাপারে তারা(সরকার) কোনো কথা বলছে না। পুলিশের গুলিতে যে মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছে সেটার ব্যাপারে কিছু বলছে না। আজকে বলছে যে, যদি কেউ আহত হয়ে থাকে তাহলে সেটাকে দেখে প্রয়োজনে চিকিৎসা দেয়ার চেষ্টা করবে। অথচ এটা সম্পূর্ণভাবে দায়িত্ব সরকারের যদি এই ধরণের ঘটনায় যে কেউ আহত হোক না কেনো তার চিকিৎসার ব্যবস্থা সরকারকেই অবশ্যই করতে হবে।”
তিনি বলেন, তাদের মূল উদ্দেশ্যটা হচ্ছে তারা গোটা আন্দোলনটাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করে ভিন্নভাবে চিহ্নিত করতে চায় … সেই আন্দোলনের মূল দাবিটা পাশ কাটাতে… দেখবেন ছাত্রদের দাবি কিন্তু পুরন হয়নি। শিক্ষার্থীদের সাথে বসেনি, স্টেকহোল্ডারদের সাথে এটা নিয়ে কথাও বলেনি।”
‘‘ তারা নিজেরাই আবার হাইকোর্ট যে সমস্যা তৈরি করেছে সেই কোর্ট দিয়ে রায়টা নিয়ে এসেছে। আপনাদের মনে থাকার কথা যখন সমস্যাটা শুরু হলো তখনই কিন্তু তারা বলতে শুরু করলো তখনই তাদের মন্ত্রীরা বললো যে এটা আদালতের বিষয় আদালতই সমাধান করবে। যখন পরে আরও বেশি বেগবান হয়েছে, আন্দোলন জোর করেছে তখন তারা বলতে শুরু করলো অপেক্ষা করো, আদালত থেকে সমাধান আসবে।অর্থাৎ সমস্যার সমাধানে যদি শিক্ষার্থীদের সাথে, স্টেকহোল্ডারদের সাথে কথা বলতো তাহলে আজকে এতো দূর পর্যন্ত গড়াতো না।”
‘এতো খারাপ অবস্থা দেখিনি’
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘‘ আজকে দেশের অবস্থা অত্যন্ত… আমরা রেসেন্টলি এতো খারাপ অবস্থা দেখিনি।”
‘‘ একটা আন্দোলনকে দমন করার জন্যে এরকম চরম শক্তি প্রয়োগ করা, সেখানে শত শত মানুষকে হত্যা করা, পরবর্তিকালে আর্মিকে নামানো কারফিউ দিয়ে… এটা ইদানিংকালে হয়নি। সরকারের চরম ব্যর্থতা সেটা প্রমাণিত হয়েছে। সরকার পরিকল্পিতভাবে এসব ঘটনাগুলো ঘটিয়েছে।”
কতজন মারা গেছে, কত জন আহত হয়েছে সে বিষয়ে সরকার কোনো তথ্য দিচ্ছে না বলে অভিযোগ করেন তিনি।
জনগন যাতে সত্য না জানতে পারে সেজ্য সরকার ইন্টারনেট পরিসেবা তথা সোশ্যাশ মিডিয়াসহ বিভিন্ন মাধ্যম বন্ধ করে রাথার সমালোচনা করেন বিএনপি মহাসচিব।
‘‘ যদি বলছে তারা ইন্টারনেট পরিসেবা চালু করেছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত তারা ইন্টারনেট চালুর সুরাহা করতে পারেনি।এতে করে যে সংবাদ মাধ্যমের কষ্ট হয়েছে বা সাধারণ মানুষের কষ্ট হয়েছে তা না, ব্যবসা-বানিজ্যের প্র্রভূত ক্ষতি হয়েছে। আপনারা দেখেছেন যে, একটা ভিডিও তৈরি করে ব্যবসায়ীদের একটা সভায় দেখানো হয়েছে সেটা সম্পূর্ণ মিথ্যাচার করা হয়েছে। তার প্রমাণ হচ্ছে যে, চট্টগ্রামের জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ক্ষমতাসীন শ্রমিক লীগের একজন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে যে, তাকে টাকা দেয়া হয়েছিলো বিআরটিসির বাসে আগুন লাগানোর জন্য। প্রথম আলো পত্রিকায় খবরটি এসেছে।”
‘কোটা আন্দোলনকারীদের সব দাবি পুরণ হয়নি’
কোটা সংস্কার আন্দোলনের বিএনপির সমর্থন ‘এখনো আছে’ জানিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘‘ কোটা সংস্কারের আমাদের সমর্থন ছিলো, এখনো আমরা দিচ্ছি। তাদের যে দাবিগুলো ছিলো তা এখনো পুরন করা হয়নি। তাদের দাবি ৮ দফা… সেগুলো কিন্তু এখনো হয়নি।”
‘‘ শুধু কোটা নয়, আরও যে দাবিগুলো আছে অবশ্যই সেসব দাবি সরকারের পুরন করা উচিত।”
তিনি বলেন, ‘‘এ সরকারের সবচেয়ে বড় সমস্যা যেটা সেটা হচ্ছে যে, জনগনের সাথে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই। জনগনের কাছে তাদের কোনো জবাবদিহিতা নেই। সে কারণে তারা জনগনের যে চোখের ভাষা, জনগনের যে মনে কথা সেটা তারা কখনো বুঝতে পারে না।”
‘‘ সেই কারণে তারা এখন মূল ফোর্সকে এপ্লাই করে নির্যাতন-নিপীড়ন করে ক্ষমতায় টিকে থাকা ছাড়া তাদের কোনো উপায় নেই। এই যে ২০১৪, ২০১৮ সাল এবং এবারকার কথা বলছেন কথনোই কিন্তু আমরা নাশকতায় জড়াইনি, আমরা কখনো জবরদস্তি কিছু করতে যাইনি। সরকার আমাদের ওপরে আক্রমন করেছে আমরা চেষ্টা করেছি প্রতিহত করবার। অনেক সময় দেখা গেছে যে, আমাদের যে দাবি দাওয়াগুলো সেই দাবিগুলো সামনে নিয়ে এসেছি। আমাদের মূল দাবি একটাই যেটা নিয়ে আমরা আন্দোলন করছি সেটা হচ্ছে, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন। সেই বিষয়টিতে সরকার না গিয়ে সরকার নানা কথা বলছে। এটা রাজনৈতিক সমাধান করতে হবে তা না হলে এটার কখনো সমাধান হবে না।”
‘দুই হাজার নেতা-কর্মী গ্রেফতার’
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘‘ আমরা এখন পর্যন্ত যেটা পাচ্ছি আমরা তো তথ্য ঠিক মতো পারছি না, যোগাযোগ ব্যবস্থা সরকার বন্ধ করে রাখায় আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছি, নেতা-কর্মীদের সাথে যোগাযোগ করা সম্ভবপর হচ্ছেনা। আমাদেরর অফিসগুলো আপনার দেখতেই পেরেছেন কিভাবে অভিযান চালিয়ে সব কিছু নিয়ে গেছে… কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে কয়েকদিন আগে কি করেছে… তালা-টালা লাগিয়ে দিয়ে্ছিলো…ক্রাইম সিন ফিতে লাগিয়ে দিয়েছিলো… তাই না। ফলে আমরা সব কিছু এখনো শুরু করতে পারিনি।”
‘‘ তবে আমাদের জানা মতে, এখন পর্যন্ত যতটুকু জানতে পেরেছি আমাদের প্রায় দুই হাজার নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে।আমাদের স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীসহ সিনিয়র নেতৃবৃন্দ, অঙ্গসংগঠনের নেতৃবৃন্দ, জাতীয় নির্বাহী কমিটির নেতৃবৃন্দ, বিরোধী দলের নেতা গণঅধিকার পরিষদের নুরুল হক নূর সাহেব আছেন, জামায়াতে ইসলামের মিয়া গোলাম পারোয়ার সাহেব আছেন, ডা.আবদুল্লাহ আবু তাহের সাহেব আছেন এই সমস্ত অনেক জাতীয় নেতাদেরকে তারা গ্রেফতার করেছেন।”
বিএনপি মহাসচিব দলের নেতা-কর্মীদের নিঃশর্ত মুক্তির দাবি জানান।
‘নাশকতা : ওরা জনগনকে ভ্রান্ত ধারণা দিতে চায়’
মৃত্যু সংখ্যার প্রসঙ্গে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘‘ কত জন এই আন্দোলনে মারা গেছে, কত জন আহত হয়েছে এটা তারা(সরকার) জানাচ্ছে না। উদ্দেশ্য হচ্ছে যে, ওরা গোটা জাতিকে ভ্রান্ত ধারণা দিতে চায়। সেখানে তারা কোটা বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের বিষয়টা পুরোপুরি বাদ দিয়ে শুধুমাত্র সরকারি স্থাপনায় হামলা-ভাংচুরের যেসব ঘটনা ঘটেছে সেগুলো সামনে আনতে চায়। এখানে বিএনপির ওপর দোষ চাপাতে চায়।”
বিএনপির ওপর নাশকতার যে অভিযোগ সরকার করছে তাকে ভিত্তিহীন দাবি করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘‘ আমরা আন্দোলনের সঙ্গে থাকা আর নাশকতার মদদ দেয়া এক জিনিস নাকি। নাশকতার মদদ তো দিচ্ছেন না তারা(সরকার)। তারা চাচ্ছেন যে এখানে নাশকতা হোক, প্রোভলেম হোক।”
‘‘ বিএনপির চল্লিশ বছরের ইতিহাসে নাই যে, বিএনপি রাষ্ট্রীয় স্থাপনার ওপরে আক্রমণ করেছে, সেখানে কোনো সমস্যা তৈরি করেছে…. আপনি পাবেন না খুঁজে। আজ পর্যন্ত যত আন্দোলন হয়েছে কোথাও কোনো রকমের রাষ্ট্রীয় স্থাপনার ওপরে বিএনপি আক্রমণ কখনো কখনো করে নাই।”
‘সত্য কথা বললেই রাষ্ট্রবিরোধী হয়ে যায়’
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘‘ এটা খুব পরিস্কার সারা বিশ্বের কাছে যে, বাংলাদেশে সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক ফ্যাসিস্ট সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাদের জনগনের প্রতি, গণতন্ত্রের প্রতি কোনো দায়বদ্ধতা নেই। আজকে এই আন্দোলনে জনসাধারণকে হত্যা করা হয়েছে সেই হত্যাগুলোর ছবি বিদেশে গেছে… সেখানে গণতান্ত্রিক দেশগুলো, গণতান্ত্রিক দেশের নেতৃবৃন্দ আছে তারা তো কথা বলবেই।”
‘‘ ড. মুহাম্মদ ইউনুস সম্পর্কে আজকে নয়, বহুদিন ধরে তারা তার ভাবমূর্তি বিনষ্ট ও তাকে হেয়প্রতিপন্ন করছে, তার বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছে, সাজাও দিয়েছে। দে্খেন তিনি ১৪ আগস্ট অলিম্পিক উদ্বোধন করবেন… গোটা বিশ্বে তিনি এতটা সমাদৃত, এতোটা বরণ্যে তার বিরুদ্ধে… তিনি নাকী রাষ্ট্রদ্রোহী বক্তব্য দিয়েছেন বলে বলা হচ্ছে। সত্য কথা বললেই রাষ্ট্রবিরোধী হয়ে যায়, সত্য কথা বললে গণবিরোধী হবে। গণবিরোধী তো হচ্ছে আওয়ামী লীগ, আসল রাষ্ট্রবিরোধী হচ্ছে আওয়ামী লীগ। গত ১৫ বছর যাবত তারা যতগুলো কাজ করেছে সবগুলো এই রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে গেছে,সব গুলো জনগনের বিরুদ্ধে গেছে।”
‘কারফিউ প্রত্যাহার চাই’
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘‘ আমরা প্রথম দিন থেকে বলে আসছি আমরা কারফিউ প্রত্যাহার চাই। জনগনের শান্তির স্বার্থে কারফিউ অবশ্যই প্রত্যাহার করা উচিত।”
এসএস/ এনজি