
• পার্ক খুঁড়ে বিশাল ভুগর্ভস্থ পার্কিং নির্মাণ করেছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়
• পার্কটির সব রাইড তুলে ফেলা হয়েছে
• এখন ৬০৩ কোটি টাকার রাইড কিনতে চায় ডিএসসিসি
• ২০২৬ সালের জুনে পার্ক চালুর সম্ভাবনা
ঈদ বা সাপ্তাহিক ছুটিতে নগরে শিশু-কিশোরদের বিনোদনে পছন্দের শীর্ষে ছিল শাহবাগের শিশুপার্ক। এখানে ছিল অল্প টাকায় সব শ্রেণির মানুষের বিভিন্ন রাইডে চড়ার সুযোগ। শিশু-কিশোরের কোলাহলে মেতে উঠতো পুরো শাহবাগ এলাকা। আধুনিকায়নের নামে গত সাত বছর ধরে পার্কটি বন্ধ রেখেছে কর্তৃপক্ষ। এতে আনন্দ-বিনোদনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে শিশুরা।
অভিভাবকদের অভিযোগ, আধুনিকায়নের নামে দীর্ঘদিন পার্কটি বন্ধ করে রেখেছে নগর কর্তৃপক্ষ। এটি তাদের উদাসীনতা ছাড়া কিছুই নয়।
নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একটি শিশুপার্ক আধুনিকায়নের নামে অর্ধযুগের বেশি বন্ধ রাখা গ্রহণযোগ্য নয়। দীর্ঘ এ সময়ে একটি প্রজন্ম আনন্দ-বিনোদন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এতে তাদের শারীরিক-মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এর দায় সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে নিতে হবে।
শিশুপার্কটির নাম একাধিকবার পরিবর্তন হয়েছে। সবশেষ নাম ছিল ‘হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী শিশুপার্ক’। অন্তর্বর্তী সরকার আসার পর আবার ‘শহীদ জিয়া শিশুপার্ক’ নামকরণের সুপারিশ করেছে পার্কটি পরিচালনার দায়িত্বে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। এটির সরকারিভাবে পরিচালিত দেশের সবচেয়ে বড় শিশুপার্ক।
৫ আগস্টের পর প্রকল্পের মালামালের দাম নিয়ে কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন। পরে এর দাম পুনর্মূল্যায়ন কমিটি গঠন করেছে ডিএসসিসি। সেই কমিটিও সব কিছু যাচাই করেছে। দামে কোনো ব্যত্যয় হয়নি। উল্টো রাইডগুলো কিনতে যত দেরি হচ্ছে, দাম ক্রমেই বাড়ছে।- ডিএসসিসির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (যান্ত্রিক) আনিছুর রহমান
শিশুপার্কটির জায়গার মালিক গণপূর্ত অধিদপ্তর। ডিএসসিসির সংশ্লিষ্টদের দাবি, আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে পার্কটি আধুনিকায়নের কাজ যথাসময়ে শেষ করা সম্ভব হচ্ছে না। যদিও এখন পার্কের রাইড কেনার প্রস্তুতি চলছে। ২০২৬ সালের জুনে পার্কটি চালুর সম্ভাবনা রয়েছে।
আধুনিকায়নে সাত বছর পার
ডিএসসিসির প্রকৌশল বিভাগ সূত্র জানায়, ২০১৮ সালে পার্কটি আধুনিকায়নে করপোরেশনকে প্রস্তাব দেয় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। প্রস্তাব অনুযায়ী, শাহবাগে যে শিশুপার্ক রয়েছে, সেটির সংস্কার ও আধুনিকায়নের জন্য একটি প্রকল্পের (স্বাধীনতাস্তম্ভ নির্মাণ–তৃতীয় পর্যায়) আওতায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনকে ৭৮ কোটি টাকা দেবে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। এর কারণ ওই প্রকল্পের জন্য শিশুপার্কের নিচ দিয়ে ভূগর্ভস্থ পার্কিং হবে। এতে পার্কের কিছু রাইড ক্ষতিগ্রস্ত হবে। নতুন রাইড কেনার পাশাপাশি পার্কের আধুনিকায়নের জন্য মূলত ওই টাকা দিতে চেয়েছিল মন্ত্রণালয়। কিন্তু টাকার পরিমাণ কম হওয়ায় প্রস্তাব নাকচ করেন সংস্থাটির সাবেক মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন।
পরে ২০২০ সালের মে মাসে ডিএসসিসির মেয়রের দায়িত্ব নেন শেখ ফজলে নূর তাপস। তিনি নিজেদের উদ্যোগে শিশুপার্ক আধুনিকায়নের সিদ্ধান্ত নেন। তখন এজন্য ৬০৩ কোটি ৮১ লাখ টাকার একটি প্রকল্প তৈরি করে ডিএসসিসি। ২০২৩ সালের আগস্টে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় এ প্রকল্প অনুমোদন হয়।
প্রকল্প পাসের সময় ঠিক হয়, প্রকল্পের ৪৮৩ কোটি টাকা দেবে সরকার। সরকারের দেওয়া টাকার অর্ধেক হবে অনুদান, বাকিটা ঋণ হিসেবে দেওয়া হবে। আর দক্ষিণ সিটির নিজস্ব তহবিল থেকে খরচ করা হবে ১২০ কোটি টাকা।
এ প্রকল্পের বেশির ভাগ ব্যয় (৪৪১ কোটি টাকা) ধরা হয় শিশুপার্কের জন্য ১৫টি রাইড কেনা ও স্থাপন বাবদ। তখন এসব রাইড ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে আনার পরিকল্পনা করা হয়। তবে দরপত্র চূড়ান্তের আগেই এসব রাইডের দাম নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এর মধ্যে গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের আগে গোপনে দেশ ছাড়েন ডিএসসিসির সাবেক মেয়র শেখ তাপস। এখন রাইড কেনার কাজটিও আটকে আছে।
জানতে চাইলে ডিএসসিসির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (যান্ত্রিক) আনিছুর রহমান বলেন, ‘বাজারদর যথাযথ মূল্যায়ন করেই ওই প্রকল্পটি তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু ৫ আগস্টের পর প্রকল্পের মালামালের দাম নিয়ে কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন। পরে এর দাম পুনর্মূল্যায়ন কমিটি গঠন করেছে ডিএসসিসি। সেই কমিটিও সব কিছু যাচাই করেছে। দামে কোনো ব্যত্যয় হয়নি। উল্টো রাইডগুলো কিনতে যত দেরি হচ্ছে, দাম ক্রমেই বাড়ছে। তাই দ্রুত সময়ের মধ্যে শিশুপার্কের রাইডগুলো কেনার প্রস্তুতি চলছে।’
যেখানে মানুষের অবসর কাটানোর জায়গার প্রচণ্ড অভাব, সেখানে একটি পার্ক খুঁড়ে ভুগর্ভস্থ পার্কিং নির্মাণের বিষয়টি কোনোভাবেই মানা যায় না। যারা এ পরিকল্পনার সঙ্গে ছিলেন, তাদের অবশ্যই জবাবদিহির আওতায় আনা প্রয়োজন।- বিআইপি সভাপতি অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিএসসিসির প্রকৌশল বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, ডিএসসিসির সাবেক মেয়র তাপসের আগ্রহে তিন বছর (২০২৩ সালের জুলাই থেকে ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত) মেয়াদি এ প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর প্রকল্পের কাজে স্থবিরতা নেমে এসেছে। পার্কের নিচে ভূগর্ভস্থ পার্কিং নির্মাণে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় যে প্রকল্প নিয়েছিল, তা চলতি বছরের জুনে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।
গত ২৫ মার্চ সরেজমিনে দেখা যায়, আগে শিশুপার্কটি যে জায়গায় ছিল, এখন তার বড় একটি অংশে ভূগর্ভস্থ পার্কিং নির্মাণ করা হয়েছে। এ পার্কিংয়ের ছাদ মাটি থেকে প্রায় চার ফুট উঁচু। এছাড়া আগে শিশুপার্কের ভেতরে যে রাইডগুলো ছিল এখন তার অধিকাংশ রাইডের অস্তিত্ব নেই। চরকি জাতীয় দুটি রাইড আট ফুট উঁচু টিন দিয়ে ঘেরা। পার্কের পশ্চিম পাশে ঝোপঝাড়ে ফেলে রাখা হয়েছে একটি জেট বিমান। বিমানের ওপর ধুলাবালিসহ লতাপাতা ছড়িয়ে রয়েছে। শিশুপার্কটিতে কোনো শ্রমিককে কাজ করতে দেখা যায়নি। আন্ডারগ্রাউন্ড পার্কিংয়ে পানি জমে মশার লার্ভা ছড়াতে দেখা গেছে।
গত ২৫ মার্চ (শুক্রবার) বিকেল তিনটায় সাত বছরের স্কুলপড়ুয়া ছেলেকে নিয়ে শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরে যান আজিমপুরের বাসিন্দা হাসিবুর রহমান। তিনটার দিকে জাদুঘর থেকে বের হয়ে শিশুপার্কের সামনে যান। এসময় আলাপকালে হাসিবুর রহমান বলেন, ‘ভাবছিলাম শিশুপার্কের সংস্কার কাজ শেষ হয়েছে। কিন্তু এসে দেখি আগের অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। পার্কে ঢোকার ফটকে তালা লাগানো। অথচ সামনে ঈদ। ঈদের ছুটিতে শিশু-কিশোরদের বেড়ানোর জন্য ঢাকায় কোনো জায়গা নেই।’
শিশুপার্কের উত্তর-পূর্ব পাশের ফুটপাতে এক যুগের বেশি সময় ধরে ফুল বিক্রি করেন মাহতাব উদ্দিন। শিশুপার্ক নিয়ে আলাপকালে তিনি বলেন, ‘আগে যখন শিশুপার্কটি চালু ছিল, ঢাকার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বাচ্চাদের নিয়ে আসতেন অভিভাবকেরা। আর পার্কে মাত্র ১০ টাকা হারে ছয়টি রাইড ব্যবহার করতে পারতো শিশুরা। ছুটির দিনগুলোতে পার্কে কোলাহল লেগে থাকতো। কিন্তু এখন আর সেই কোলাহল নেই।’
ভুগর্ভস্থ পার্কিং করতে গিয়ে দীর্ঘদিন ধরে পার্কটি বন্ধ রাখায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন নগর পরিকল্পনাবিদদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউশন অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান।
তিনি বলেন, ‘যেখানে মানুষের অবসর কাটানোর জায়গার প্রচণ্ড অভাব, সেখানে একটি পার্ক খুঁড়ে ভুগর্ভস্থ পার্কিং নির্মাণের বিষয়টি কোনোভাবেই মানা যায় না। যারা এ পরিকল্পনার সঙ্গে ছিলেন, তাদের অবশ্যই জবাবদিহির আওতায় আনা প্রয়োজন।’
তিনি বলেন, ‘শিশুদের মানসিক বিকাশে খেলাধুলার বিকল্প নেই। কিন্তু পর্যাপ্ত পার্ক-মাঠ না থাকায় ঢাকার শিশুদের সেই সুযোগ নেই। এ ব্যর্থতার দায় নগর কর্তৃপক্ষের।’
বারবার নাম বদল
ডিএসসিসির সম্পত্তি বিভাগ সূত্র জানায়, ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের অধীন এ শিশুপার্ক স্থাপন করা হয়। ১৫ একর জমির ওপর এ পার্কের অবস্থান। ১৯৮৩ সালে তৎকালীন ঢাকা মিউনিসিপ্যাল করপোরেশনের কাছে এ পার্ক হস্তান্তর করা হয়। তখন এটি ‘ঢাকা শিশুপার্ক’ নামে পরিচিত ছিল।
সাদেক হোসেন খোকা যখন অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র হন, তখন তিনি এ পার্কের নামকরণ করেন ‘শহীদ জিয়া শিশুপার্ক’। তবে শেখ ফজলে নূর তাপস ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র হওয়ার পর ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসে পার্কটির নতুন নামকরণ হয় ‘হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী শিশুপার্ক’। পরে গত ২০ ফেব্রুয়ারি ডিএসসিসির বোর্ড সভায় শাহবাগের ওই শিশুপার্কটির নাম ফের ‘শহীদ জিয়া শিশুপার্ক’ করার সুপারিশ করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। তবে এ বিষয়ে এখনো প্রজ্ঞাপন হয়নি।
টি আই/ এনজি