সকাল ১০:১২ | মঙ্গলবার | ৮ই এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৫শে চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, বসন্তকাল | ৯ই শাওয়াল, ১৪৪৬ হিজরি

এক্সটার্নাল শরিয়াহ অডিট কতটা গুরুত্বপূর্ণ

মতামত

 

সিপিএ

০৬ মার্চ ২০২৫

 

বাংলাদেশে ইসলামিক ব্যাংকগুলোর সংখ্যা দেশের ব্যাংক খাতের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ দখল করে আছে। তবে এ বৃদ্ধির পাশাপাশি শরিয়াহ বিধিবিধান পরিপালন এবং সঠিক প্রয়োগ নিয়ে উদ্বেগও বৃদ্ধি পেয়েছে। বিষয়টি সম্প্রতি ইসলামিক ব্যাংক খাতের সুশাসন ও তারল্য সংকটের কারণে বেশি আলোচনায় এসেছে। এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে ইসলামিক ব্যাংকগুলোর সততা, স্বচ্ছতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা বজায় রাখার জন্য এক্সটার্নাল শরিয়াহ অডিট ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। যদিও পাবলিক কোম্পানিগুলোর জন্য এক্সটার্নাল আর্থিক অডিট রিপোর্ট বাধ্যতামূলক, ইসলামিক ব্যাংকগুলোর জন্য এক্সটার্নাল শরিয়াহ অডিট রিপোর্টিং বাধ্যতামূলক নয়। এটি আশ্চর্যজনক। অথচ শরিয়াহ নির্দেশিকা মেনে চলা ইসলামিক অর্থায়নের মূল ভিত্তি।

ইসলামিক ব্যাংকিং শরিয়াহ নীতির ওপর ভিত্তি করে পরিচালিত হয়, যা সুদ (রিবা), অত্যধিক অনিশ্চয়তা এবং অনৈতিক বা ক্ষতিকর কার্যক্রমে বিনিয়োগ নিষিদ্ধ করে। অভ্যন্তরীণ শরিয়াহ বোর্ড ও কমিটি ব্যাংকগুলোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, তবে তাদের তত্ত্বাবধান কখনো কখনো অভ্যন্তরীণ পক্ষপাত বা সম্পদের সীমাবদ্ধতার কারণে সীমিত হতে পারে। এখানেই এক্সটার্নাল শরিয়াহ অডিটের ভূমিকা আসে। এক্সটার্নাল শরিয়াহ অডিট ইসলামিক ব্যাংকগুলো সত্যিকার অর্থে শরিয়াহ নীতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণভাবে পরিচালিত হচ্ছে কি না, তা একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ মূল্যায়ন প্রদান করতে পারে, যার মাধ্যমে স্টেকহোল্ডারদের স্বার্থরক্ষা করা যায় এবং জনগণের আস্থা জোরদার করা যায়।

এক্সটার্নাল শরিয়াহ অডিটে ব্যাংকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয় এমন যোগ্য শরিয়াহ বিশেষজ্ঞ ও পণ্ডিতদের দ্বারা একটি স্বাধীন পর্যালোচনা করা হয়। এ প্রক্রিয়াটি নিশ্চিত করে যে, ব্যাংকের কার্যক্রম, পণ্য ও লেনদেনগুলো ইসলামী নীতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ কি না, তা গভীরভাবে পরীক্ষা করা হয়। এই অডিটে অর্থায়ন কার্যক্রম, বিনিয়োগ পোর্টফোলিও, লাভ বণ্টন প্রক্রিয়া এবং সামগ্রিক সুশাসন কাঠামোর মতো ক্ষেত্রগুলো অন্তর্ভুক্ত থাকে।

এক্সটার্নাল শরিয়াহ অডিট একটি ব্যাংকের শরিয়াহ নীতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হওয়ার বিষয়ে একটি নিরপেক্ষ যাচাইকরণ প্রদান করতে পারে, যা গ্রাহক, বিনিয়োগকারী এবং নিয়ন্ত্রকদের মধ্যে এর বিশ্বাসযোগ্যতা বৃদ্ধি করে। এক্সটার্নাল শরিয়াহ অডিট প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শরিয়াহ পালনের ক্ষেত্রে ফাঁক ও দুর্বলতা চিহ্নিত করা যায়, যা ব্যাংকগুলোর জন্য এই সমস্যাগুলো সমাধান করার সুযোগ তৈরি করে। এটি কেবল সুশাসনকে শক্তিশালী করে না, বরং শরিয়াহ মেনে না চলার ঝুঁকিও হ্রাস করে, যা সুনামের ক্ষতি ও আর্থিক ক্ষতির কারণ হতে পারে। ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের জন্য তাদের ধর্মীয় মূল্যবোধের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ব্যাংকিং করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এক্সটার্নাল শরিয়াহ অডিট গ্রাহকদের এই নিশ্চয়তা দেয় যে, তাদের আর্থিক লেনদেন হালাল (অনুমোদিত) এবং নিষিদ্ধ উপাদান থেকে মুক্ত।

এক্সটার্নাল শরিয়াহ অডিট গুরুত্বপূর্ণ হলেও, বাংলাদেশে এক্সটার্নাল শরিয়াহ অডিট বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে যোগ্য শরিয়াহ অডিটরের অভাব, শরিয়াহ নীতির বিভিন্ন ব্যাখ্যা এবং অডিট পরিচালনার জন্য একটি প্রমিত কাঠামোর অভাব। এই সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক এবং অন্যান্য স্টেকহোল্ডার শক্তিশালী নির্দেশিকা প্রণয়ন, শরিয়াহ অডিটরদের প্রশিক্ষণ ও সক্ষমতা বৃদ্ধিতে বিনিয়োগ এবং এক্সটার্নাল অডিটের সুবিধা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য একসঙ্গে কাজ করতে পারে।

বাংলাদেশ ব্যাংক ইসলামী ব্যাংকগুলোর জন্য নিয়ন্ত্রক কাঠামোর অংশ হিসেবে এক্সটার্নাল শরিয়াহ অডিট বাধ্যতামূলক করার মাধ্যমে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এ ছাড়া, ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস (সিএ) অব বাংলাদেশ, ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিলের (এফআরসি) মতো পেশাদার সংস্থাগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে একত্রে কাজ করে এক্সটার্নাল শরিয়াহ অডিটের সেরা অনুশীলন প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং ইসলামী ব্যাংকগুলোর মধ্যে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির সংস্কৃতি গড়ে তুলতে পারে।

বাংলাদেশের ইসলামিক ব্যাংক খাতে সাম্প্রতিক সংকট শক্তিশালী সুশাসন প্রক্রিয়ার গুরুত্বের একটি স্পষ্ট অনুস্মারক। এক্সটার্নাল শরিয়াহ অডিট শরিয়াহ নীতির সঙ্গে সম্মতিপূর্ণতা নিশ্চিত করার, সুশাসন বৃদ্ধি করার এবং স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে আস্থা গড়ে তোলার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে কাজ করতে পারে। এক্সটার্নাল শরিয়াহ অডিট ব্যবস্থা শুরু করার মাধ্যমে বাংলাদেশের ইসলামিক ব্যাংকগুলো শুধু তাদের কার্যক্রমকে শক্তিশালী করবে না, বরং দেশের ইসলামী অর্থায়ন শিল্পের টেকসই উন্নয়নেও অবদান রাখবে। এভাবে তারা ইসলামিক ব্যাংকিংয়ের প্রকৃত চেতনা বজায় রাখবে এবং নৈতিক, শরিয়াহসম্মত আর্থিক সেবার প্রতিশ্রুতি পূরণ করবে।

 

 

লেখক:  সহকারী অধ্যাপক, RMIT ইউনিভার্সিটি, অস্ট্রেলিয়া

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *