সকাল ৬:২৩ | রবিবার | ২০শে এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৭ই বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, গ্রীষ্মকাল | ২১শে শাওয়াল, ১৪৪৬ হিজরি

উত্তরার সাত হাসপাতালে আহত মানুষের ঢল নেমেছিল

নিজস্ব প্রতিবেদক
২৬ জুলাই ২০২৪

 

উত্তরা হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রটির বঁা পায়ে ও পায়ুপথে গুলি লেগেছে। ১৮ জুলাইয়ের ঘটনা। ওই দিন বিকেলে ওই স্কুল এবং আরও কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা উত্তরার আজমপুরের রবীন্দ্রসরণিতে বিক্ষোভে অংশ নেন। তখন অনেকের সঙ্গে এই ছাত্রও গুলিবিদ্ধ হন।

ছাত্রটির সঙ্গে কথা হয় গত মঙ্গলবার। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে ছিলেন, সোজা হয়ে বসতে বা দাঁড়াতে পারেন না। তাঁর বড় ভাই তাঁকে খাইয়ে দিচ্ছিলেন।

এত চিকিৎসক, নার্স কোথায় পাব? যাঁরা ছিলেন, তাঁরা কেউই এই পরিস্থিতির জন্য তৈরি ছিলেন না। তারপরও আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করেছি সেবা দেওয়ার।

কোটা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে র‍্যাব-পুলিশের পাল্টাপাল্টি ধাওয়া। গত বৃহস্পতিবার (১৮ জুলাই) বেলা দেড়টার দিকে উত্তরায়
কোটা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে র‍্যাব-পুলিশের পাল্টাপাল্টি ধাওয়া। গত বৃহস্পতিবার (১৮ জুলাই) বেলা দেড়টার দিকে উত্তরায়ছবি: আল-আমিন
ছাত্রটি জানালেন, গুলি লাগার পর তিনি রাস্তায় পড়ে যান। আরও অনেক আহত শিক্ষার্থীর সঙ্গে তাঁকে কাছের উত্তরা ক্রিসেন্ট ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড কনসালটেশন সেন্টারে নেওয়া হয়। তাঁর ভাষ্য, ওই দিন যাঁরা বিক্ষোভে অংশ নিয়েছিলেন, তাঁরা সবাই ছাত্র। ওই দিন আহত বা নিহত হয়ে যাঁরা হাসপাতালে গিয়েছিলেন, সবাই কোনো না কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী।

১৮ জুলাই এবং তার পরের দিন যে রাস্তায় বিক্ষোভ ও গুলির ঘটনা ঘটেছিল, সেই রাস্তাতেই ক্রিসেন্ট হাসপাতালের একাধিক ভবন। গত বুধবার ওই বেসরকারি হাসপাতালের পরিচালক (প্রশাসন) কমান্ডার (অব.) মো. নাজমুল ইসলামের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। তিনি বলেন, ১৮ ও ১৯ জুলাই দুই দিনে এক শর মতো আহত রোগীকে তাঁরা চিকিৎসা দিয়েছেন। প্রথম দিনে যাঁরা এসেছিলেন, তাঁরা প্রায় সবাই শিক্ষার্থী। দ্বিতীয় দিনে যাঁরা এসেছিলেন, তাঁদের অনেককেই ছাত্র মনে হয়নি।

কমান্ডার (অব.) মো. নাজমুল ইসলাম বলেন, দুই দিনে নিহত পাঁচজনকে এই হাসপাতালে আনা হয়। তাঁদের একজনের বয়স ৬০ বছরের কাছাকাছি, তিনি পথচারী বা রিকশাওয়ালা। একজনের বয়স ৩০ বছরের মতো। বাকি তিনজনের বয়স ২০-২১ বছর। শেষের তিনজন সবাই ছাত্র।

উত্তরা এলাকার সাতটি সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল ঘুরে গত মঙ্গলবার ও গতকাল বুধবার জানা যায়, কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে শুরু হওয়া সংঘর্ষ ও পরবর্তী সংঘাত চলাকালে হাসপাতালগুলোতে আহত মানুষের ঢল নেমেছিল। সেখানে চিকিৎসা নেন অন্তত ৮৬৭ জন আহত ব্যক্তি। মৃতদেহ এসেছিল ২৯টি। আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছিলেন চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা। কয়েকটি ক্ষেত্রে আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসা দিয়ে চাপের মুখে পড়তে হয় বলেও অভিযোগ করেছেন একাধিক চিকিৎসক।

উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপপরিচালক মেজর (অব.) মো. হাফিজুল ইসলাম নিজে একজন চিকিৎসক। সেই সময়কার পরিস্থিতি বর্ণনা করে তিনি  বলেন, ‘রোগী ঢল নেমেছিল। আমরা এত মানুষকে কোথায় জায়গা দেব? এত চিকিৎসক, নার্স কোথায় পাব? যাঁরা ছিলেন, তাঁরা কেউই এই পরিস্থিতির জন্য তৈরি ছিলেন না। তারপরও আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করেছি সেবা দেওয়ার।’

উত্তরার আজমপুরের রবীন্দ্রসরণি রেখে কিছু পথ হাঁটলেই উত্তরা ৭ নম্বর সেক্টরের লেক ড্রাইভ রোড। সেখানে রাস্তার দুপাশে দুটি বহুতল ভবনে হাই-কেয়ার জেনারেল হাসপাতাল। এই হাসপাতালের তথ্য কর্মকর্তা রাসেল মিয়া জানালেন, ১৮ জুলাই দুপুরের পর এই হাসপাতালে ৩৫-৩৬ আহত শিক্ষার্থী এসেছিলেন। তাঁরা ছররা গুলি, কাঁদানে গ্যাস (টিয়ার শেল) ও ইটপাটকেলের আঘাতে আহত ছিলেন। তাঁরা বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী। তাঁদের মধ্যে দু-তিনজন ছাত্রীও ছিলেন।

উত্তরা এলাকায় ১৯৮৬ সাল থেকে বাস করছেন, এমন একজন চিকিৎসক নাম প্রকাশ না করার শর্তে  বলেন, উত্তরা মূলত আবাসিক এলাকা। এই এলাকায় এমন সংঘর্ষ কল্পনার বাইরে।

সেক্টর-১১ এর গরিব-ই-নওয়াজ অ্যাভিনিউয়ের শুরুতে লুবানা জেনারেল হাসপাতাল ও কার্ডিয়াক সেন্টার। মূলত হৃদ্‌রোগ চিকিৎসার জন্য হাসপাতালটি পরিচিত। এই হাসপাতালেও আহত ব্যক্তিরা এসেছিলেন।

হাসপাতালটির সহকারী ব্যবস্থাপক মো. আবদুল হান্নান বলেন, ১৮ জুলাই (বৃহস্পতিবার) বিকেল চারটা থেকে ছয়টার মধ্যে চারজন আহত ব্যক্তি এসেছিলেন। এ ছাড়া গুলিতে নিহত একজন এসেছিলেন, যাঁকে ছাত্র বলেই মনে হয়েছে। আরও একজন ‘ক্রিটিক্যাল’ রোগী ছিল। তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উদ্দেশে পাঠানো হয়েছিল। তবে গিয়েছিল কি না, তা তিনি জানেন না।

একই রাস্তায় তিনটি বহুতল ভবনে শিন-শিন জাপান হাসপাতাল। ১৮-১৯ জুলাই এই হাসপাতালে ২৫ জন রোগী এসেছিলেন বলে  জানান হাসপাতালের মহাব্যবস্থাপক মো. শরিফুল ইসলাম। তিনি বলেন, যাঁরা এসেছিলেন, তাঁরা সবাই ছাত্র। তাঁরা ছররা গুলি বা বুলেটে আহত ছিলেন। এ ছাড়া দুটি মৃতদেহ এসেছিল। মৃতদেহ দুটি ঢাকা মেডিকেলের উদ্দেশে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন তাঁরা।

উত্তরা এলাকায় একটি মাত্র বড় সরকারি হাসপাতাল, নাম বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হাসপাতাল। হাসপাতালের পরিচালক মিজানুর রহমান জানিয়েছেন, এই হাসপাতালে ১৮, ১৯ ও ২০ জুলাই ২৬৫ জন আহত ব্যক্তি এসেছিলেন। আর এসেছিল আটটি মৃতদেহ। মৃতদেহগুলো ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেলে পাঠানো হয়েছিল।

উত্তরা ১১ নম্বর সেক্টরে বেসরকারি সৈয়দ মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন শিক্ষক জানিয়েছেন, সংঘর্ষের প্রথম দুই দিনে ১৭৫ জন আহত ব্যক্তি এই হাসপাতালে আসেন। তাঁদের অধিকাংশই ছিলেন শিক্ষার্থী। আর এসেছিল দুটি মৃতদেহ। কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মৃতদেহ হাসপাতালে ঢুকতে দেয়নি।

উত্তরা এলাকায় রোগীর চাপে পড়েছিল ৯ নম্বর সেক্টরের উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। হাসপাতালের উপপরিচালক মেজর (অব.) মো. হাফিজুল ইসলাম  বলেন, সংঘর্ষে হাসপাতালে আসা সব আহত ও নিহত ব্যক্তির সংখ্যা ও বিবরণ (ডকুমেন্টেশন) সঠিকভাবে রাখা সম্ভব হয়নি। চার দিনে এই হাসপাতালে ২৬৩ জন আহত ব্যক্তি এবং ১১টি মৃতদেহ এসেছিল। এর মধ্যে ১৮ জুলাই ১৭৯ জন আহত ব্যক্তি ও ছয়টি মৃতদেহ, ১৯ জুলাই ৫৯ জন আহত ব্যক্তি ও পাঁচটি মৃতদেহ, ২০ জুলাই ২৩ জন আহত ব্যক্তি এবং ২১ জুলাই দুজন আহত ব্যক্তি হাসপাতালে আসেন।

রাজধানীর রামপুরা এলাকায় দু–তিন দিন সংঘর্ষ চলে। আহত ও নিহতের সঠিক তথ্য পাওয়া কঠিন। সংঘর্ষের বিভিন্ন পর্যায়ে অনেক রোগী এসেছিলেন রামপুরার বনশ্রী এলাকার ফরাজী হাসপাতালে।

হাসপাতালটির উপমহাব্যবস্থাপক মো. রুবেল হোসেন  বলেন, ১৮ জুলাই ৩০০ আহত ব্যক্তি ও ৫টি মৃতদেহ এসেছিল। ১৯ জুলাই ৬০০ আহত ব্যক্তি ও ১০টি মৃতদেহ এসেছিল। ২১ জুলাই এসেছিল ৫০ জন আহত ব্যক্তি। আহত ব্যক্তির প্রায় সবাইকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। ১৫টি মৃতদেহ আত্মীয়দের কাছে দেওয়া হয়।

বেসরকারিতে উদ্বেগ

সরকারি হাসপাতালের মতো বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো হঠাৎ বিপুলসংখ্যক রোগীর চিকিৎসা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল না। তাদের জনবল, শয্যা ও ওষুধের সীমাবদ্ধতা আছে। তারপরও তারা চিকিৎসা দিয়েছে। তবে অনেকেই কিছু সমস্যা, কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয়ের কথা বলেছেন।

বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হাসপাতাল এবং মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ছাড়া বাকি ছয়টি হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স ও ব্যবস্থাপক সূত্র বলছে, কিছু ক্ষেত্রে রোগীদের ভয়ভীতি দেখানো হয়েছে। আহত ব্যক্তিদের রাখার কারণে চাপের মুখে পড়তে হয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি হাসপাতালের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা রোগীর সেবা দেব, নাকি এসব ঝামেলা সামলাব।’

বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) নীতি বলছে, রোগীর স্বার্থ সবার ওপরে। নীতি অনুসারে রোগী ছাড়া সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির আর কোনো পরিচয় নেই। জাতি, ধর্ম বা রাজনৈতিক পরিচয় চিকিৎসার জন্য বাধা হতে পারে না। আন্তর্জাতিক বিধিবিধানও তাই। এ ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে বিএমডিসির সভাপতি অধ্যাপক মাহমুদ হাসান  বলেন, ‘বিএমডিসির কোনো প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা নেই। এটি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, বিশেষ করে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের দেখার দায়িত্ব।’

উত্তরার অধিকাংশ হাসপাতালে রোগীদের বড় অংশ চিকিৎসা শেষ না করেই হাসপাতাল ছেড়েছেন। এসব রোগীর ভয় ছিল, হাসপাতালে থাকলে ঝামেলায় পড়তে হতে পারে। চিকিৎসা শেষ না করা অনেকের জন্য ঝুঁকি হয়ে থাকবে।

হাসপাতালে চিকিৎসা না দেওয়ার বিষয়ে চাপ তৈরি এবং রোগীদের ভীতির বিষয়গুলো জানিয়ে বক্তব্য জানতে চাইলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী সামন্ত লাল সেন বলেন, ‘বিষয়টি কেউ আমার নজরে আনেনি।’

 

 

জা ই /এনজি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *