বিশেষ প্রতিবেদন
মোহাম্মদ জাফর ইকবাল
২৪ এপ্রিল ২০২৫
সড়কপথে যানজটের বিড়ম্বনা এড়াতে আকাশপথে যাতায়াতের প্রবণতা বাড়ছে। ফলে লাভজনক হয়ে উঠছে অ্যাভিয়েশন খাত। আকাশপথের প্রতিটি রুটেই যাত্রীদের চাহিদা থাকায় টিকিট পাওয়া যায় না। বর্তমানে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, শাহ আমানত, সিলেটের ওসমানী, কক্সবাজার, যশোর, সৈয়দপুর, বরিশাল ও রাজশাহী বিমানবন্দর দিয়ে বিমান চলাচল করছে। এবার আরও কয়েকটি বিমানবন্দর সচলের উদ্যোগ নিয়েছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। বিমানবন্দরগুলোর সংস্কারে কী পরিমাণ অর্থ ব্যয় হবে তা নিরূপণের কাজ প্রায় শেষ। জানা গেছে, দেশের অথনীতিকে চাঙ্গা করার পাশাপাশি পর্যটন খাতের সম্ভবনা বৃদ্ধি এবং সড়ক ও রেলপথে চাপ কমানোই অন্যতম লক্ষ্য কর্তৃপক্ষের। বেবিচক জানায়, এসব বিমানবন্দর দ্র্রুত চালু করার পাশাপাশি বন্ধ থাকা ২৮ টি বিমানবন্দরও চালু করার উদ্যোগ নেয়া হবে।
জানা গেছে, বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ আপাতত ঈশ্বরদী, ঠাকুরগাঁও, লালমনিরহাট, বগুড়া, শমসেরনগর, কুমিল্লা ও তেজগাঁও বিমানবন্দর চালু করতে চায়। ইতোমধ্যে আগামী জুলাই মাসে বগুড়া বিমানবন্দর চালু করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এছাড়া লালমনিরহাট বিমান বন্দর ও শমসেরনগর বিমান বন্দর চালু করার জন্য বেবিচকের ৪ সদস্যের একটি টিম সরেজমিনে পরিদর্শন করেছেন। তারা বিমানবন্দর ২টি চালু করার বিষয়ে বেবিচক চেয়ারম্যানের কাছে প্রতিবেদন জমা দিবেন। তারপর দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। এছাড়া অন্য বিমানবন্দরগুলো অবিলম্বে পরিদর্শন করে দেয়া রিপোর্টের ভিত্তিতে ব্যবস্থা গ্রহন করবে বেবিচক।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইতোমধ্যে বগুড়া বিমানবন্দর চালু করার বিষয়ে কাজ চলছে। আসছে জুন মাসে সচল হবার সম্ভবনা রয়েছে। তবে, বানিজ্যিকভাবে শুরু হতে ১ থেকে দেড় বছর সময় লাগতে পারে। জানা গেছে, ১৯৯১-৯৬ মেয়াদে বিএনপি সরকার সেখানে বিমানবন্দর স্থাপনের নীতিগত সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করে। ১৯৯৫ সালে সদর উপজেলার এরুলিয়ায় বগুড়া-নওগাঁ মহাসড়কের পাশে ১০৯ একর জমি অধিগ্রহণ করে সরকার। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর রানওয়ে, কার্যালয় ভবন ও কর্মকর্তাদের জন্য আবাসিক ভবন নির্মাণ, বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহ ব্যবস্থা, রাস্তাঘাট নির্মাণসহ প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ শুরু হয়। প্রকল্পের কাজ শেষ হয় ২০০০ সালে। জানা গেছে, বগুড়া বিমানবন্দর চালু করার জন্য ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার বাজেট ধরা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রতিবছর গড়ে প্রায় পাঁচ হাজার বিদেশি পর্যটক বগুড়ায় আসা-যাওয়া করেন। বাংলার প্রাচীন রাজধানী মহাস্থানগড়সহ একাধিক ঐতিহাসিক স্থাপনা আছে সেখানে। সরকারি-বেসরকারি ছোট-বড় প্রায় ২০টি শিল্পকারখানা রয়েছে। তার মধ্যে এসেনশিয়াল ড্রাগস, ওয়ান ফার্মাসিউটিক্যালস, ট্রান্সকম কনজ্যুমার প্রোডাক্ট, উত্তরা মোটরস ও এবিসি টাইলস উল্লেখযোগ্য। বগুড়ায় চার তারকা হোটেল রয়েছে দুটি। বাণিজ্যিকভাবে বিমানসেবা চালুর মতো সব ধরনের অনুকূল পরিবেশ আছে সেখানে।
লালমনিরহাটের জেলার প্রশাসক এইচ এম রকিব হায়দার বিমানবন্দর চালু করার জন্য বেবিচক চেয়ারম্যানকে চিঠি দিয়েছেন। এর প্রেক্ষিতে পরিদর্শক দল পাঠানো হয়েছে। চিঠিতে বলা হয়, বাংলাদেশের উত্তর জনপদের প্রান্তিক জেলা লালমনিরহাটে বিট্রিশ শাসনকালে বাংলাদেশে নির্মিত ৬টি বিমানবন্দরের অন্যতম বৃহত্তম বিমানবন্দরটি অবস্থিত। প্রাপ্ত তথ্যমতে, ১৯৩১ সালে নির্মিত ৪ কিলোমিটার রানওয়ে বিশিষ্ট এই বিমানবন্দরটি দক্ষিণ এশিয়ার ২য় বৃহত্তম বিমানবন্দর হিসেবে পরিচিত। একটি বিমানবন্দরের উল্লেখযোগ্য অবকাঠামো যেমন ৪ কিলোমিটার রানওয়ে, বিশাল টারমাক, হ্যাঙ্গার, ট্যাক্সিওয়ে ইত্যাদি অবকাঠামো পরিত্যক্ত এ বিমানবন্দরে বিদ্যমান রয়েছে। সামান্য সংস্কার করা হলেই এগুলো ব্যবহারোপযোগী হয়ে উঠবে। এ বিমানবন্দর চালু করতে কোন ভুমি অবিগ্রহণের প্রয়োজন হবেনা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে সর্বশেষ এই বিমানবন্দরটি ব্যবহৃত হয়েছে যা বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলসহ ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় ৩৭টি রাজ্য, নেপাল ও ভুটানে যোগাযোগের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু ছিল। স্বাধীনতা লাভের পরে বিভিন্ন সময়ে পরিত্যক্ত এ বিমানবন্দরটি চালুর দাবী করা হলেও এখনও চালু হয়নি।
চিঠিতে আরো বলা হয়, লালমনিরহাট জেলা বাংলাদেশের প্রান্তিক ও ভারতের সীমান্তবর্তী হওয়ায় এ জেলাসহ পার্শ্ববর্তী কুড়িগ্রাম, রংপুর জেলার কিছু অংশ, গাইবান্ধা জেলা ও নীলফারী জেলার কিছু অংশের যোগাযোগ ব্যবস্থা বেশ অনুন্নত। এ কারণে এ অঞ্চলের দারিদ্রতার হার সর্বোচ্চ। শিক্ষার হার, বিদেশে কর্মরত প্রবাসীর সংখ্যা, অর্থনৈতিক অঞ্চল ও শিল্পকারখানার সংখ্যার বিবেচনায় দেশের অন্যান্য অঞ্চলের খুলনায় এ অঞ্চল অনেক পিছিয়ে। কুড়িগ্রামের সোনাহাট স্থলবন্দর ও লালমনিরহাটের বুড়িমারী স্থলবন্দর চালু হলেও যোগযোগ ব্যবস্থার কারণে এখানে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের ব্যাপক সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো যায়নি। এছাড়াও সম্প্রতি কুড়িগ্রামে ভুটানের জন্যে একটি আন্তর্জাতিক ইপিজেড স্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। পরিত্যক্ত এ বিমানবন্দরটি চালু হলে উত্তরাঞ্চলের সবচেয়ে দরিদ্র জেলা লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রাম হয়ে উঠবে উত্তরাঞ্চলসহ ভারতের ৭ রাজ্য, নেপাল, ভুটান, সিকিম ও তিন্মত অঞ্চলের জন্য এক আকর্ষণীয় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক ও পর্যটন কেন্দ্র। এর ফলে এ অঞ্চলের দারিদ্রতার অবসান ঘটবে এবং টেকসই লক্ষ্যমাত্রা-২০৩০ অর্জিত হবে।
জানা গেছে, ১৯৪২ সালে ব্রিটিশরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান, মালয়েশিয়া, মিয়ানমার (বার্মা) ও ইন্দোনেশিয়াকে দখল করার উদ্দেশে একসঙ্গে বড় যে দু’টি বিমানবন্দর নির্মাণ করেছিল, তার একটি হচ্ছে কমলগঞ্জের শমসেরনগর বিমানবন্দর। তৎকালীন সময়ে বিমান বন্দরটির নামকরণ করা হয় ‘দিলজান্দ বন্দর’। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে নাম পরিবর্তন করে রাখা হয়- ‘শমসেরনগর বিমানবন্দর’। অযত্ন-অবহেলায় পড়ে থাকা বিমানবন্দরে ১৯৭৫ সালে বিমান বাহিনীর একটি ইউনিট খোলা হয়। সেখানে বিমান বাহিনীর তত্ত্বাবধানে একটি প্রশিক্ষণ স্কুল চালু করা হয়। সেই থেকে বিমান বাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান ও হেলিকপ্টার ওঠানামা করছে এখানে। ৬০০০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৭৫ ফুট প্রস্থ বিশিষ্ট এ বিমানবন্দরের বড় একটি অংশ পতিত থাকায় বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন মেয়াদে স্থানীয়দের কাছে ইজারা দিয়ে যাচ্ছেন। পার্শ্ববর্তী সিলেট এমএজি ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এখন যাত্রীর চাপও বেড়ে গেছে। ফলে বিমানবন্দরটি চালু হলে এ চাপ কমে আসবে। মৌলভীবাজার জেলাসহ আশেপাশের কয়েকটি জেলার মানুষ উপকৃত হবেন। প্রবাসী ও পর্যটকদের যোগাযোগ সহজ হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতের ‘চিকেনস নেক’র কাছাকাছি হওয়ায় লালমনিরহাট বিমানবন্দর চালু নিয়ে ভারতের আপত্তি থাকতে পারে। এজন্যই হয়তো বিগত সরকার কোনো উদ্যোগন নেন নি। বর্তমান সরকার উদ্যোগ নেয়ায় ভারত আপত্তি জানিয়েও সুবিধা করতে পারবে না। উপরন্তু বাংলাদেশ ভু-রাজনীতিতে এগিয়ে থাকবে।
বিমানের সাবেক পরিচালনা পর্ষদ সদস্য ও এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল আলম বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে আকাশ পথের ব্যবহার বেড়েছে। এটি শুধু বাংলাদেশে নয়। বিশ্বের সব ক্ষেত্রেই এটি হচ্ছে। তিনি বলেন, দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা আর সচল করার পাশাপাশি পর্যটর খাতকে প্রাণবন্ত করতে বিমানবন্দর গুলোকে সচলের উদ্যোগ নিতে হবে।
সূত্র মতে, আগামী এক বছরের মধ্যে অন্তত তিনটি বিমানবন্দরের কার্যক্রম শুরু করার চেষ্টা করছে বেবিচক। সংস্থাটির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা এ প্রতিবেককে বলেন, পরিত্যক্ত বিমানবন্দরের জায়গা প্রভাবশালী মহল দখল করে ব্যবসায়িক কার্যক্রম চালাচ্ছে। কেউ কেউ বসতভিটা তৈরি করে বসবাস করছে। সংশ্লিষ্টদের উচ্ছেদ করতে আমরা চেষ্টা চালাচ্ছি। আশা করি আগামী এক বছরের মধ্যে অন্তত তিনটি বিমানবন্দর চালু করা সম্ভব হবে।
জানা গেছে, ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত ঈশ্বরদী বিমানবন্দরে নিয়মিত ফ্লাইট পরিচালনা করা হয়েছে। ২০১৩ সালে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ এখান থেকে বাণিজ্যিক ফ্লাইট চালু করলেও, পরের বছরই তা বন্ধ হয়ে যায়। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে ঈশ্বরদী বিমানবন্দরকে ঘিরে নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। নেউরা-ঢুলিপাড়ার পাশে কুমিল্লা বিমানবন্দর ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ রুটে সচল ছিল। ১৯৯৪ সালে আবার ফ্লাইট চালু হলেও যাত্রীসংকটের কারণে বন্ধ হয়ে যায়। বিমানবন্দর-সংলগ্ন ইপিজেড রয়েছে, কিন্তু যোগাযোগ সমস্যার কারণে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। ১৯৮০ সাল থেকে ঠাকুরগাঁও বিমানবন্দর অচল। আশির দশকের পর লালমনিরহাট বিমানবন্দরে ফ্লাইট চলাচল করেনি। বাগেরহাটের খান জাহান আলী বিমানবন্দরের নির্মাণকাজ দ্রুত শুরু করতে বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ২০১৫ সালে একনেকে এসবের চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়। বরাদ্দ করা হয় ৫৪৪ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। কিন্তু চারপাশের দেয়াল নির্মাণ ছাড়া আর কিছুই হয়নি। ২০১৮ সালের জুন মাসে কাজ শেষ করার কথা ছিল। কুমিল্লার পাশেই পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে একসময়কার এশিয়া মহাদেশের বৃহত্তম বিমানবন্দর ফেনী বিমানঘাঁটি যা দশম বিমানবাহিনী ১২তম বোমারু গ্রুপের প্রাথমিক আবাস, যেটি দক্ষিণ ইতালির দ্বাদশ বিমানবাহিনী থেকে পুনরায় নিয়োগের পর এ বিমানঘাঁটি থেকে বি-২৫ মিচেল মধ্যম বোমারু বিমান উড়িয়েছিল। সীমান্তবর্তী অত্যন্ত গুরত্বপূর্ণ এই বিমানবন্দর চালুর প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে।
সার্বিক বিষয়ে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মঞ্জুর কবীর ভূঁইয়া বলেন, পরিত্যক্ত বিমানবন্দরগুলো সচল করা সময়ের দাবি। তবে অবকাঠামো নির্মাণ, সংস্কার ও আনুষঙ্গিক প্রস্তুতি যেখানে আগে শেষ হবে, সেগুলো আগে সচল হবে। সবার আগে চালু হবে বগুড়া বিমানবন্দর। তিনি বলেন, এরপর লালমনিরহাট বিমানবন্দর চালু করার ব্যবস্থা করা হবে। এখানে বিমান বাহিনীর সাথে আমরা একটা এমওইউ করবো, এরপর অপারেশনে যাওয়া যাবে। তবে বানিজ্যিকভাবে চালু করতে কিছু রিনোভেশন করতে হবে। রানওয়ে ১০ হাজার ফিট করতে হবে। তিনি বলেন, আমরা কয়েকটি বিমানবন্দর চালু করতে কাজ করছি। কমার্শিয়াল করতে গেলে, টার্মিনাল বিল্ডিং, রানওয়েসহ কিছু রিনোভেশন লাগবে, এগুলো করতে সময় লাগবে। আবার অনেক বিমানবন্দর অসাধুরা দখলে নিয়েছে। আমরা সব বিমানবন্দরের বিষয়ে রিপোর্ট দেয়ার নির্দেশ দিয়েছি।
জা ই / এনজি